বাসস
  ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৩
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১০:৪৬

অন্তর্বর্তী সরকার ১৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকার বৈদেশিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছে

মোশতাক আহমদ

ঢাকা, ৭ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গত এক বছরে প্রায় ১৮ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা বৈদেশিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা । আদানি পাওয়ার লিমিটেডের বকেয়া ছিল ৭ হাজহার ৯৩৪.৮৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে বর্তমানে বকেয়া রয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৬৩.৫০ কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি তারা  বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৬ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তরল জ্বালানি ভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি আমদানির সার্ভিস চার্জ ৯ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৫ শতাংশ করার মাধ্যমে ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। তরল জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি শিপমেন্টে ১৫ হাজার মেট্রিক টন এর পরিবর্তে ২০ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণের ফলে ৩৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাতারবাড়ি কয়লাা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ ৮.৪৪৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিদ্যুতের বর্তমান গড় বিক্রয় মূল্য ৮.৯৫ টাকার চেয়ে কম। এ কার্যক্রমের ফলে বছরের প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

এছাড়াও অন্যান্য বিদ্যুত কেন্দ্রের ট্যারিফ হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দশটি  মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরাতন আইপিপি তথা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসর প্রদান করা হয়েছে,  যার মাধ্যমে সরকারের ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে ২৬৩০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর ৬ শতাংশ উৎসে কর কমানোর লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে। স্থাপনা ভাড়া, এলডি আদায় ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে ৯২১০  কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে।

এছাড়া ২০২৫ সালের ৬ মে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০২৫ পরিবর্তন সাপেক্ষে অনুমোদিত হয়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০২৫ পরিমার্জন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুমোদন গ্রহণ করা হয়েছে। পরিমার্জিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০২৫ গত ১৬ জুন বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা-২০২৫ অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় সকল সরকারি অফিস এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ছাদে ওপেক্স বা কেপেক্স মডেলের রুফটপ সোলার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে ২০০০ থেকে ৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে। এছাড়াও নেট মিটারিং গাইড লাইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদান ও বিক্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক মার্চেন্ট পাওয়ার পলিসি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে । চলতি বছর জুলাইয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়।

৪টি ধাপে উন্মুক্ত দর পদ্ধতির মাধ্যমে ৫৫টি স্থানে ৫২৩৮ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্যাকেজ ০-৪৯ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন সাবস্টেশনের ১২৭ প্যাকেজের (৩৫৩ মেগাওয়াট) বিপরীতে ২ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ৯৮টি দরপত্র বিক্রি করা হয়েছে। এই দরপত্র দাখিলের সময়সীমা ২০২৫ সালের ২ জুন উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতে ৯৮টি দরপত্র দলিল বিক্রয়ের বিপরীতে ২০টি দরপত্র দলিল জমা পড়েছে।

প্যাকেজ ৫০ মেগাওয়াট এর বিভিন্ন সাবস্টেশনের ১০টি প্যাকেজের (৫০০ মেগাওয়াট) বিপরীতে ২০২৫ সালের ১৮ জুন পর্যন্ত ৪৬টি দরপত্র বিক্রি করা হয়েছে। এ দরপত্র দলিল ২০২০ সালের ১৮ জুন উন্মুক্ত করা হয়েছে। ৪৬টি দরপত্র দলিল বিক্রয়ের বিপরীতে ২১টি দরপত্র দলিল জমা পড়েছে।

প্যাকেজ ৫১-১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন সাবস্টেশনের ১৯টি প্যাকেজের (১৭৮০  মেগাওয়াট) বিপরীতে ২০২৫ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত ৬৯টি দরপত্র বিক্রি করা হয়েছে। এ দরপত্র দলিল ২০১৫ সালের ২৩ জুন উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতে ৬৯টি দরপত্র দলিল বিক্রয়ের বিপরীতে ২৯টি দরপত্র দলিল জমা পড়েছে।

প্যাকেজ ১০১-১৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন সাবস্টেশনের ১৪টি প্যাকেজের বিপরীতে ২০২৫ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ২৯টি দরপত্র বিক্রি করা হয়েছে। এ দরপত্র দলিল ২০১৫ সালের ১৪ জুন উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতে ২৯টি দরপত্র দলিল বিক্রয়ের বিপরীতে ৫টি দরপত্র দলিল জমা পড়েছে।

মর্চেন্ট পাওয়ার পলিসি-২০২৫ এর খসড়া প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামত গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েব সাইটে  দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে খসড়া পলিসি চূড়ান্তকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড  (বাউবি) থেকে বড় পুকুরিয়ায় ২০ মেগাওয়াট, রাঙ্গুনিয়ায় ৫০ মেগাওয়াট, এবং কাপ্তাইয়ে ৭.৬ মেগাওয়াট ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিবেশ দূষণ হ্রাসের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বর্জ্য (মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্ট) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ছে।

আইএসডিই অর্থায়নে ইজিসিবি কর্তৃক সোনাগাজীতে ৩২২০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

এছাড়া কেএফডব্লিও-এর অর্থায়নে আরপিসিএল থেকে গজারিয়ায় ১০ মেগাওয়াট ব্যাটারি স্টোরেজসহ ৬৫ মেগাওয়াট সোলার স্টোর যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শকের দপ্তর হতে প্রতি মাসেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক স্থাপনা পরিদর্শন করে বিভিন্ন ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে পরবর্তীতে সমাধান করা হয়। যার ফলে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানের বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এ কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি স্থিতিশীল রাখার জন্য স্পিনিং রিজার্ভ বৃদ্ধি করে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি, বাবিউবো এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ২০১৬ সাল থেকে নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। গত জুন মাস  থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ  কেন্দ্রসমূহের এফজিএমও সিস্টেম চালু করায় সিস্টেনের স্পিনিং রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জাতীয় গ্রিডের র্ফ্রিকোয়েন্সি ফ্লাকচুয়েশন কমেছে।

এনএলডিসি থেকে প্রাপ্ত সাপ্তাহিক প্রতিবেদন অনুসারে, নিয়মিত এফজিএমও পদ্ধতিতে পরিচালনায় সক্ষম বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬১টি। তবে গ্যাস স্বল্পতার কারণে ৬১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে বেশ বিছু সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্র ফিক্সলোড এ পরিচালিত হচ্ছে।

জানুয়ারি-জুন,২০২৪ এবং জানুয়ারি-জুন,২০২৫ সালের ফ্রিকোয়েন্সির তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফ্রিকোয়েন্সি নরমাল রেঞ্জে (৪৯.৫-৫০.৫ এইচজেড) থাকার সময়কাল পূর্বের তুলনায় ১৮৭৬ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি হ্রাসে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছর  যেখানে ভর্তুকির চাহিদা ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা, সেখানে এ বছর তা কমিয়ে আনা হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকায়।