শিরোনাম
ঢাকা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): এক বছর আগেও মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল দুই অঙ্কের বেশি। গত এক বছরে সেই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে দুই অঙ্কের নিচে নেমে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পিত ও বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং নীতির কারণেই এ পরিবর্তন এসেছে। যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতারও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়। তার পূর্বে দেশে ছিল চরম অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা। সেসময় দেশে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়ে আর্থ-সামাজিক খাতে বিপর্যয় ঘটে এবং মুদ্রাস্ফীতি চরমে পৌঁছায়। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
কিন্তু, ক্ষমতার পটপরিবর্তন এবং সময়ের পরিক্রমায় গত এক বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে। দেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির চাপ অনেকাংশেই কমে এসেছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের মাত্র কয়েকদিন আগেও, দেশের সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১.৬৬ শতাংশ। যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। এর মূল কারণ ছিল খাদ্যের মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, যেটি পৌঁছেছিল ১৪.১০ শতাংশে। এটি অন্তত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯.৬৮ শতাংশে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ২০২৫ সালের জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৭.৩৯ শতাংশে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মে মাসে এ হার ছিল ৮.৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতিও কমে দাঁড়ায় ৯.৩৭ শতাংশে। যা মে মাসে ছিল ৯.৪২ শতাংশ।
গত জুলাই মাসে গ্রাম ও শহরাঞ্চল উভয় স্থানে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতির হারও কমতে দেখা যায়। জুন মাসে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা মে মাসে ছিল ৯.০৫ শতাংশ।
এটি ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হার এবং ২০২৩ সালের মার্চের পর প্রথমবার ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত উভয় পণ্যের দাম কমায় মুদ্রাস্ফীতি কমেছে।
নীতিনির্ধারক এবং অর্থনীতিবিদরা এটিকে দেখছেন দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নতির প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সামগ্রিক সফলতার বিষয়ে বাসসের সঙ্গে কথা বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এমনভাবে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে, যাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের পতনের পর ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় মাঝেও সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
উপদেষ্টা বলেন, দুর্বল ব্যাংক খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকার সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। সঙ্গে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি যতটা সম্ভব কমিয়ে জিডিপির ৪ শতাংশের নিচে রাখার চেষ্টা করা হয়। যাতে চলতি অর্থবছরে সরকারের দেশীয় ও বিদেশি ঋণের পরিমাণ খুব বেশি না বাড়ে।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ উল্লেখ করেন, এটি অবশ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জন্য সুবিধাজনক হয়েছিল। একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি কিছুটা কমাতে হয়েছে, অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারও কিছুটা ছোট করা হয়। এটি বাজেট ঘাটতি ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে।
নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে কমছে এবং আগামীতে আরো কমবে। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়লে নিম্নআয়ের মানুষ এর সুফল পাবে না।
‘শিক্ষিত বেকারদের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। তবে এসবের সমাধান রাতারাতি করে ফেলা সম্ভব নয়’ বলেও মন্তব্য করেন উপদেষ্টা।
এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে এবং চিকন চাল ও সবজির দাম কমেছে। তবে বেশিরভাগ দরিদ্র শ্রেণির প্রধান খাবার মোটা চালের দাম এখনো কিছুটা বেশি।’
খাদ্য মূল্যস্ফীতির জন্য প্রায় ৫০ শতাংশই চাল দায়ী বলে গত জুনে মন্তব্য করেন পরিকল্পনা কমিশনের এই সদস্য। আগের মাসে (মে) এই হার ছিল ৪০ শতাংশ। তিনি বলেন, সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমলেও চালের দাম বাড়ছে, যা উদ্বেগের বিষয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর গভীর অনুসন্ধান করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাজার তদারকি জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ ্রচেষ্টা করতে হবে।
চালের মূল্যবৃদ্ধির পেছনের কারণ জানতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. মনজুর বলেন, আমরা চালের দামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে কোন সুস্পষ্ট কারণ দেখতে পাচ্ছি না। মজুদ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ছে। তবে প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যদি চালের দাম না কমে, তাহলে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতির হারও তেমন কমবে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
সম্প্রতি বাসসের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতির হারের হ্রাসের কারণে গত জুনে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি কমে যায়। শহর ও গ্রামে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে।
প্রখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ আরো জানান, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
এর পেছনে প্রধান তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেন ড. জাহিদ। সেগুলো হল, গত বছরের বন্যার পর অনুকূল আবহাওয়া, স্থিতিশীল বিনিময় হার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচক্ষণ মুদ্রানীতি। তার মতে, এসব নিয়ামক খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করেছে।
তিনি আরো বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বোরোসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য এবং মৌসুমি ফলের ভালো উৎপাদন ভোক্তাদের জন্য স্বস্তি এনেছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে মুদ্রাস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। দীর্ঘ সময় পর জুন মাসে তা ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
সরকার যদি এই কৌশল ধরে রাখতে পারে, তবে আগামী মাসগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি আরো কমতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
এফবিসিসিআই প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বাসস’কে বলেন, আগের তুলনায় এ বছর বাজার নজরদারি আগের চেয়ে অনেক ভালো হওয়ায় সাধারণ মানুষ মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা তুলনামূলক কম অনুভব করেছে। এটি সার্বিক অর্থনীতির জন্য ভালো দিক।