বাসস
  ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৩৬

রিজার্ভ পুনরুদ্ধার : অর্থনীতিতে স্বস্তির ইঙ্গিত

ফাইল ছবি

ঢাকা, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫(বাসস) : বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধার ও রেমিট্যান্স প্রবাহে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও আস্থার পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই ধারাবাহিক অগ্রগতি বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের ওপর চাপ হ্রাস এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির কার্যকারিতা নির্দেশ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

তবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) পদ্ধতিতে হিসাব করলে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মোট রিজার্ভের ভিত্তিতে এই পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান, আর আইএমএফের পদ্ধতিতে হিসাব করলে তা সামান্য কম, প্রায় ৫ মাসের সমান।

যদিও এটিকে ‘অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক’ অবস্থা বলা যায় না (কারণ আদর্শ রিজার্ভ হওয়া উচিত কমপক্ষে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় কভার করা), তবুও বর্তমান পরিস্থিতি মোটের ওপর স্বস্তিদায়ক বলে বিবেচিত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক স্বস্তি এনে দেওয়া এই পরিবর্তনের মূল কারণ হলো রেমিট্যান্স প্রবাহে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি। যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে শুরু হয়।

এই প্রবাহ বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মাঝেও দেশের অর্থনৈতিক সহনশীলতার জন্য এক ‘আশার আলো’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। যা ২০২০-২১ অর্থবছরের আগের রেকর্ড ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি।

এই গতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি।

অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবসায়ী মহল লক্ষ্য করেছেন যে, এই অসাধারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

এই তহবিলগুলো কেবল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেই শক্তিশালী করেনি, বরং টাকার বিনিময় হারও স্থিতিশীল করেছে, ফলে জাতীয় মুদ্রার ওপর চাপ কমেছে।

আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপপরিচালক থমাস হেলব্লিং সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘দেশের লেনদেন ভারসাম্যের উপর চাপ বজায় থাকায় রিজার্ভের সঞ্চয়কে আইএমএফ-সমর্থিত কর্মসূচির একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।’

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার হয়েছে, যদিও তা সামান্য।

লেনদেন ভারসাম্য ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মতো বৈদেশিক সূচকগুলো আরও স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছে।

খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও একমত পোষণ করে বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধি রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি উল্লেখ করেন, ডলার সংকটের সময় ব্যাংকগুলোর এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।

ব্যাংকার ও কর্মকর্তারা বলেন, রেমিট্যান্সের আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাহ বৃদ্ধির পেছনে সরকারী নীতি ও বাজারের স্থিতিশীলতা উভয়ই ভূমিকা রেখেছে।

প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে এবং জাতীয় স্বার্থে সরকার বর্তমানে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে।

এছাড়া, স্থিতিশীল বিনিময় হার অবৈধ অর্থপ্রেরণ পদ্ধতি (যেমন হুন্ডি) নিরুৎসাহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে ব্যাংক ও খোলা বাজারের বিনিময় হারের পার্থক্য খুবই সামান্য। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৫০ পয়সা বিনিময় হার পাচ্ছেন, যেখানে খোলা বাজারে তা প্রায় ১২৩ টাকা।

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ নিশ্চিত করেছেন যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর হুন্ডি ও হাওলা চ্যানেলের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানোর ফলে এসব অবৈধ পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে এবং আরও বেশি রেমিট্যান্স এখন আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসছে।

তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক প্রভাব এখন সারাদেশে দৃশ্যমান, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো স্বস্তি পাচ্ছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আব্দুল কায়উম চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাসের পর অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দিয়েছে।

তিনি বলেন, এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে থাকা একটি দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক স্বস্তি হিসেবে কাজ করছে।