শিরোনাম
ঢাকা, ২৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়) ড. শেখ মইনউদ্দিন বলেছেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের সড়ক, রেল, নৌ, বিমান ও সমুদ্র বন্দর এবং ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ের সমন্বয়ে একটি বহুমাত্রিক পরিবহন ইকোসিস্টেম প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, ‘আগামী ২৫-৫০ বছরের জন্য উপযোগী একটি সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে বেসরকারিখাতকে এগিয়ে আসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো আমাদের কোনো দীর্ঘমেয়াদি বৃহৎ মাস্টারপ্ল্যান নেই। নীতি প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারার কারণে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই গৃহীত নীতিমালা হতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছে না।
আজ ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে লজিস্টিক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শেখ মইনউদ্দিন এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সলিম উল্লাহ এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)-এর চেয়ারপার্সন আবুল কাসেম খান।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স ২০২৩’-এর তথ্য মতে লজিস্টিক খাতে বিশ্বের ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮। বন্দরে যানজট, কাস্টমস প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা ও অপ্রতুল অবকাঠামো আমাদের আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি সামগ্রিক ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াকে প্রতিনিয়ত ব্যাহত করছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ হয়ে থাকে। জিডিপিতে বন্দর দুটোর অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ, এমতাবস্থায় উল্লিখিত বন্দরসহ দেশের সকল রেল, স্থল, নৌ, সামুদ্রিক ও বিমান বন্দরগুলোসহ সার্বিক লজিস্টিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি এবং এক্ষেত্রে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই, তা না হলে আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ব।
মো. সলিম উল্লাহ বলেন, সম্প্রতি প্রণীত লজিস্টিক নীতিমালা পুনঃমূল্যায়নের জন্য সরকার ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে। দেশের আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বিআইডব্লিউটিএ শিগগিরই একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
বিল্ডের চেয়ারপার্সন আবুল কাসেম খান বলেন, বাস্তবতা হলো বিশেষকরে লজিস্টিক খাতে আমরা একটি জায়গায় আটকে আছি, আমাদের অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি এবং বিষয়টি বেশ হতাশার।
তিনি বলেন, অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে আগামী ৫০ বছরের জন্য একটি টেকসই অবকাঠামো তৈরির মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া প্রয়োজন, এটি সময়ে দাবি। লজিস্টিক খাতের উন্নয়ন তদারকির জন্য তিনি আলাদা মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষ গঠন এবং ২০২৬-৩৫ পর্যন্ত সময়কালকে ‘লজিস্টিক দশক’ ঘোষণার প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এম মাশরুর রিয়াজ।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে আমাদের বেসরকারিখাতের নেতৃত্বে পরিচালিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও বিশেষকরে তৈরি পোষাক খাত এবং কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দেশ ও অঞ্চলের বাজারের উপর আমাদের রপ্তানি পণ্যের নির্ভরশীলতা একটি ঝুঁকির বিষয়। সেই সঙ্গে প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির বিষয়টিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এমন বাস্তবতায় অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণে বেশি মনোযোগী হওয়ার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাণিজ্য সহযোগিতা এবং লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’
লজিস্টিকের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি উল্লেখ করেন, কেবল এখাতে যদি ২৫ শতাংশ ব্যয় হ্রাস করা যায়, তাহলে প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। সেই সঙ্গে পরিবহন ব্যয় ১ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব হলে ৭.৪ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়াও জাতীয় লজিস্টিক নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সেক্টর ডেভেলপমেন্ট রোডম্যাপ মাস্টারপ্ল্যান একান্ত আবশ্যক।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)-এর নির্বাহী পরিচালক আলমগীর মোর্শেদ, ডিপি ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর শামীম উল হক, বাংলাদেশ সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির সভাপতি নকিব খান এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর (এডিবি) সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার (ট্রান্সপোর্ট) হুমায়ুন কবীর অংশগ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোর সক্ষমতা দাঁড়াবে ১০ মিলিয়ন টিইইউস। যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বেসরকারিখাতকে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু প্রতি ৫ বছরে প্রায় ২ শতাংশ করে জমি কমে যাচ্ছে, তাই লজিস্টিক বিশেষ করে পরিবহন পরিষেবায় রেলওয়ে হতে পারে সবচেয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী উপযোগী ব্যবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সীতাকুন্ড পর্যন্ত কেবল ট্রাক ও লরির জন্য একটি বিশেষায়িত এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করতে পারলে আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক সুফল পাওয়া যাবে। এছাড়াও পানগাঁও নদীবন্দরকে সফলভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারিখাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ইডকলের নির্বাহী পরিচালক আলমগীর মোর্শেদ অবকাঠামোখাতে দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নের জন্য একাধিক বন্ড ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেন। যেহেতু লজিস্টিক খাতে আমাদের সক্ষমতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, তাই এখাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা ইতিবাচকভাবে দেখা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এডিবি’র হুমায়ুন কবীর বলেন, বাংলাদেশের লজিস্টিক পলিসি বাস্তবায়নে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এর পক্ষ হতে টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদান করা হবে এবং এ লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে এডিবি একযোগে কাজ করছে।
মুক্ত আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব.) এম খালেদ ইকবাল, বারবিভার সভাপতি আব্দুল হক, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ওসামা তাসীর, সাবেক সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ, সাবেক পরিচালক এ কে ডি খায়ের মোহাম্মদ খান এবং ডিসিসিআই’র স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক আবরারুল আলম প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।