বাসস
  ০৫ মে ২০২৫, ১২:১৬

হেফাজতের ওপর বর্বরতার এক যুগ আজ : বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

\দিদারুল আলম\

ঢাকা, ৫ মে, ২০২৫ (বাসস) : আজ থেকে এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছিলেন অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লাখো নেতা-কর্মী।

সেই সমাবেশ থেকে পেশ করা দাবী বিষয়ে ওই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে কোন সুরাহা না হওয়ায় সমাবেশ অব্যাহত থাকে। সেদিন ৫ মে দিন গড়িয়ে রাত হলে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নাম দিয়ে এক ভয়াবহ অভিযানে মতিঝিল-শাপলা চত্বর এলাকা বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। শান্তিপূর্ণ অবস্থান পণ্ড করতে চালানো ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ অভিযানে হতাহতের ঘটনা আজো রহস্যাবৃত।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পরিচালিত ওই নির্মমতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবী হেফাজতসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী শাপলা চত্বরে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নাম দিয়ে ভয়াবহ ক্র্যাকডাউনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় হেফাজত ইসলামের ৬১ জন নিহত হন। নিহতদের নাম পরিচয় ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে অধিকার।

অধিকার এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় আওয়ামী লীগ সরকার অধিকারের তৎকালীন সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান এবং সংগঠনের পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯) এর ৫৭ ধারায় মামলা করে। আওয়ামী সরকারের সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আদালত দণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে।

শাপলা চত্বরের ঘটনায় হতাহতের তথ্য কোনভাবেই যেন জনসম্মুখে না আসে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর শাপলা চত্বরে হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা (মিস কেস) হয়েছে।

মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের সুনির্দিষ্ট নামোল্লেখ করে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আরো রয়েছেন-সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক, পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর হেফাজতে ইসলামের নেতা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ অভিযোগ করেন।

মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা অভিযোগ দায়ের করেছি। এখন প্রসিকিউশন তথ্য সংগ্রহ করে মামলা করবেন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত আছে।’

একই বিষয়ে মুফতি হারুন ইজহারের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি অভিযোগ করা হয়।

অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক এমপি হাজী সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহমেদ, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, নির্মূল কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার, একাত্তর টিভির সাবেক সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, সময় টিভির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহমেদ জোবায়ের, এবিনিউজ২৪ ডটকমের সম্পাদক সুভাস সিংহ রায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং এনএসআইয়ের মো. মনজুর আহমেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসান ঘটে। এরপর তাদের সময়ে সংঘটিত হত্যা-গণহত্যা, গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের দাবী জোরদার হয়। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।

শাপলা চত্বরের ঘটনায় হেফাজতে ইসলাম মামলা করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ১৩ বছর আগে ঘটে যাওয়া নারকীয় এ ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারা, কীভাবে জড়িত এবং এর মূল হোতা কারা ছিলেন, তা উদ্ঘাটন করতে পুলিশের কাছে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। জড়িতদের মধ্যে অনেকের নাম-পরিচয় এবং ওই রাতে তাদের কী ভূমিকা ছিল, এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে তথ্য আসতে শুরু করেছে বলে সূত্র জানায়।

গত ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফতেহ্ মো. ইফ্তেখারুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে সাবেক সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলীয় নেতৃত্ব এবং সশস্ত্র ব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে শাপলা চত্বর, মতিঝিল এবং এর আশপাশ এলাকায় ব্ল্যাক আউট করে জমায়েত হওয়া নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। এতে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এ মর্মে প্রাপ্ত অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্তাধীন রয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা সুষ্ঠু ও যথাযথ তদন্তের স্বার্থে নিম্নবর্ণিত তথ্যাদি জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।’

চিঠিতে অভিযান সম্পর্কিত আট ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সমাবেশ ঘিরে ডিএমপির নিরাপত্তা পরিকল্পনার সত্যায়িত কপি, অভিযানে ব্যবহৃত এপিসি (আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার), কমান্ড ভেহিক্যাল ও রায়টকার চালকদের নাম, পদবি ও মোবাইল নম্বর। এছাড়া অপারেশনে ইস্যুকৃত অস্ত্রের ধরন, গুলি, ব্যবহৃত গোলাবারুদের হিসাব এবং গুলিবর্ষণের ঘটনায় কোনো প্রশাসনিক তদন্ত হয়ে থাকলে প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি, এজাহার এবং পুলিশ রিপোর্টের কপি দিতে বলা হয়েছে।

চিঠিতে তৎকালীন কমিশনারসহ ডিএমপির সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে ১০ জন কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়। তারা হলেন- পুলিশের মতিঝিল বিভাগের তৎকালীন এডিসি (অতিরিক্ত উপকমিশনার) এসএম মেহেদী হাসান, এডিসি আসাদুজ্জামান, ট্রাফিক (পূর্ব) বিভাগের এডিসি মোহাম্মদ মাইনুল হাসান, রমনা বিভাগের এডিসি মনজুর রহমান, এডিসি আনোয়ার হোসেন, ডিবি (পশ্চিম) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মশিউর রহমান (বর্তমানে কারাবন্দি), ডিবির (দক্ষিণ) এডিসি নাসির উদ্দিন খান, লালবাগের তৎকালীন ডিসি আলোচিত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদ এবং উপ-কমিশনার (ডিসি) খান মুহাম্মদ রেজোয়ান।

এর বাইরে ডিএমপির সব অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্মকমিশনার, ডিবিসহ সব বিভাগের ডিসি (উপকমিশনার), ডিসি ট্রাফিক (পূর্ব), ডিসি (অর্থ ও বাজেট), ডিসি (ইএন্ডডি), ডিসি (মিডিয়া), এডিসি ওয়ারী, এডিসি পিআরএইচআরডি, এডিসি প্রকিউরমেন্ট, ডিবির সব বিভাগের এডিসি, এসি, ওমেন সাপোর্ট সেন্টার ও ইনভেস্টিগেশন শাখার সহকারী কমিশনার, এসি (সহকারী কমিশনার) মতিঝিল ও খিলগাঁও জোন, এসি ট্রাফিক মতিঝিল ও রমনা জোন, এসি প্যাট্রল (মতিঝিল), পল্টন এবং ওয়ারী থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা), পল্টন, রমনা, হাজারীবাগ, সবুজবাগ এবং মতিঝিল থানার তৎকালীন ইনস্পেকটর তদন্ত পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

ভয়াবহ ওই অভিযানে হতাহতের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত হবে বলে প্রত্যাশা বিচারপ্রার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের।