শিরোনাম
ফরিদপুর, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দেশের মধ্যাঞ্চলের কৃষিনির্ভর জেলা ফরিদপুর, যা পাটের রাজধানী হিসেবেই পরিচিত। ফরিদপুরে চলতি মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়া ও কৃষকদের পরিশ্রমের ফলে পাটের অধিক ফলন হয়েছে, যা জেলার ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। জেলা জুড়ে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ পাট ক্ষেত থেকে কাচা পাট সংগ্রহের পর কৃষকরা পাট জাগ দেয়া ও আঁশ ছড়ানোসহ নানা প্রক্রিয়া করণের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এ বছর পাটের অধিক ফলন দেশের অন্যতম প্রধান পাট উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে ফরিদপুরের অবস্থানকে আরো সুসংহত করছে।
পাট উৎপাদনে অগ্রগামী হওয়ায় এ জেলার ব্র্যান্ডিং স্লোগান 'সোনালি আঁশে ভরপুর ভালোবাসি ফরিদপুর'। জেলায় এ বছর পাটের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮৬,৫৩১ হেক্টর ছুঁয়েছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৬,৫২৫ হেক্টর।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার ফরিদপুরে ২ লক্ষাধিক টন পাট উৎপাদন হয়েছে, যার বাজার মূল্য দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। ফরিদপুরের মাটি পাট চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় এবং আবহাওয়া অনেকটা অনুকূলে থাকায় উৎপাদনের লক্ষমাত্রাও নির্ধারিত সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।
পাট আবাদের চলতি মৌসুমের শুরুতে খরা এবং এর কিছুদিন পরেই আকস্মিক অতি বৃষ্টির কারণে নীচু এলাকায় দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকে। এতে কিছু কিছু এলাকায় পাটের আকার প্রত্যাশিত মাত্রায় বৃদ্ধি পায়নি, যা সীমিত পরিসরে ফসলের ক্ষতির কারণ হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও জেলার অধিকাংশ এলাকায় পাটের ফলন ভালো হয়েছে, যা কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। তবু কৃষকরা পাটের ন্যায্য দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। বীজ, জৈব ও রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং শ্রমিকদের মজুরির মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তাদের লাভের সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে। তারা সরকারের কাছে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা এবং বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছেন।
বোয়ালমারী, মধুখালী, নগরকান্দা এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর বেশি বৃষ্টিপাত থাকায় পর্যাপ্ত পানিতে পাট পচাতে পেরেছেন তারা। ফলে পাটের মান উন্নত হয়েছে। পাটের রং ভালো হওয়ায় তারা খুশি।
কৃষকরা মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা গেলে আগামীতে পাট চাষ আরো বেশি সম্প্রসারিত হবে।
জেলাবাসী মনে করেন, ফরিদপুরের 'সোনালি আঁশ' শুধু জেলার পরিচিতিই নয়, কৃষকদের জীবন-জীবিকারও প্রতীক। সঠিক নীতি ও সহায়তা পেলে এ ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহাদুজ্জামান বলেন, "পাট উৎপাদনে ফরিদপুর সবসময়ই শীর্ষে। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে পাটের আবাদ হয়েছে। আমরা আশা করছি, এ বছর অধিক ফলন হয়েছে।" এবং কৃষকরা ও তাদের ন্যায্য মূল্য পাবে। আর কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
অধিক পরিমাণে পাট উৎপাদন ও সহজলভ্যতার কারণে ফরিদপুর অঞ্চলে পারটেক্স জুট মিলস লি., ফরিদপুর জুট ফাইবার্স লি. ফরিদপুর জোবায়দা করিম জুট মিলস, শরীফ জুট মিলস, আলতু খাঁন জুট মিলস, দাহমাসি জুট মিলস, রাজ্জাক জুট মিলট লি. সহ অন্তত ২০টি পাটকল গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কার্পেট, চটের ব্যাগ, বস্তা, সুতা, দড়িসহ নানা ধরণের পণ্য। যা পরিবেশ বান্ধব ও দৃষ্টি নন্দন।
শুধু তাই নয় পাটের তৈরি পণ্যকে বিশ্ব বাজারে তুলে ধরতে এ জেলায় কাজ করছেন অনেক নবীন প্রবীণ উদ্যোক্তা। পণ্যের হাত ধরে পাটের শুধু বাজারই বিস্তৃত হচ্ছে না, বরং পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিষপত্র মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সক্ষম হচ্ছে। পাটের তৈরি পণ্যের চাহিদার বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত এ খাতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা। যাদের মেধার বিচ্ছুরণে পাট জাতীয় পণ্য তৈরি ও মানের উন্নয়ন ঘটছে।
এসব উদ্যোক্তাদের সংগ্রহে রয়েছে আকর্ষণীয় কার্পেট, পর্দার কাপড়, কুশন কভার, সোফার কভার, জুতা, স্যান্ডেল, বিছানার চাদর, দড়ি, ঝুড়ি, চটের ব্যাগ, বস্তা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের হস্ত শিল্প ও শো-পিস সামগ্রী। এমনকি পাট দিয়ে জুট জিও-টেক্সটাইল, কার্পেট ব্যাংকিং, জুট পলিমার ও পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
স্থানীয় যে কোনো ধরনের মেলা কিংবা সাংস্কৃতিক আয়োজনে পাট পণ্যের পসরা সদাই নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের। পাটের প্রতি ভালোবাসায় দর্শনার্থীরা পছন্দের পণ্যটি ক্রয় করতে পেরে আনন্দিত হন। এমনকি পাটের তৈরি পণ্য সামগ্রী প্রিয়জনকে উপহারও দিয়ে থাকেন।
গুণে-মানে অনন্য ও আপন স্বকীয়তায় প্রতিনিয়ত পাট ও পাটজাত পণ্যের প্রসার ঘটছে। যদিও এ খাতের ব্যাপক প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন স্থানীয় পাটকল সংশ্লিষ্ট ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। তারা মনে করেন, পাট পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তা অনেকেরই ক্রয়সীমার বাইরে থাকে।
তাই তারা মনে করেন পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার বিদেশে সম্প্রসারণ করা গেলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে।