বাসস
  ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৩:২৫
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৪৫

তিস্তায় মাছ ফুরিয়ে যাচ্ছে, শঙ্কায় জেলেরা

তিস্তা নদীতে আগের মতো মাছ পাচ্ছে না জেলেরা। ছবি :বাসস

 

/শফিকুল ইসলাম বেবু/

কুড়িগ্রাম, ২৬ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): এক সময় প্রাচুর্যে ভরা ছিল উত্তরাঞ্চলের প্রাণ তিস্তা নদী। অথচ এখন এটি প্রাণহীন। এ নদীতে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এতে নদীপাড়ের জেলে পরিবারগুলো টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে কষ্টের মধ্যে দিয়ে। ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় তারা।

জানা গেছে, তিস্তা ভারতের সিকিম রাজ্যে উৎপত্তি হয়ে দেশের গাইবান্ধা জেলার হরিপুরে ব্রহ্মপুত্রে পতিত হয়েছে। এটি উৎপত্তিস্থল থেকে হরিপুর পর্যন্ত ৩১৫ কিলোমিটার।

বাংলাদেশ অঞ্চলের ১১৫ কিলোমিটার উত্তরের ৫ জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ১৩টি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তাপাড়ে ৩২টি জেলেপাড়া রয়েছে। প্রতিটি জেলেপাড়ায় ১০০-২৫০টি পরিবার বসবাস করে।

সরেজমিনে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০ বছর আগেও তিস্তা নদীতে একসময় দেশি কার্প জাতের রুই, কাতলা, মৃগেল, বড় আকৃতির বোয়াল, টেংরা, আইড়, গোঁস, শোল, গজার, পাবদা, চিংড়ি, চাঁদা, পুঁটি, মলা, ঢেঁকী, তাকি, ডারকিনা, চিতল প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ত। কিন্তু এখন মাছ মিলছে খুবই কম পরিমাণে।  

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার জেলেপাড়া এলাকার ৬৫ বছর বয়সী জেলে সুধাচরণ দাস স্মৃতিচারণ করে বলেন, নব্বই দশকে দিনে কয়েক ঘণ্টা জাল ফেললেই নৌকা ভরে যেত মাছে। ২০-৩০ কেজি মাছ ছাড়া বাড়ি ফিরতাম না। এখন দিনে এক কেজিও পাই না।

তিনি বলেন, এখন বর্ষার মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে জালে ওঠে বৈরালি, টেংরা, কালিবাউশ, কৈ, শোল, বোয়াল, পুঁটি—তাও অল্প পরিমাণে।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালে প্রায় ১৭ হাজার পেশাজীবী জেলে তিস্তায় মাছ ধরতেন, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র দুই হাজারে।০ আর জেলেদের তথ্যে, আগের তুলনায় তাদের আয় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।

জলজ জীববৈচিত্র্য হ্রাসের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে রয়েছে পানির প্রবাহ ব্যাহত, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজে পানি প্রত্যাহার আর বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজে নিয়ন্ত্রণের কারণে শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যায়। বর্ষায় আবার হঠাৎ বন্যায় ডিম ছাড়ার জায়গা ভেসে যায়। আবার পলি জমে নদীর খাল-বিল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে যায়, কারেন্ট জাল, পোনা ধরার জাল নির্বিচারে ব্যবহারে মাছের পুনরুৎপাদন ব্যাহত হয়।

এছাড়া কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, ইটভাটার ধোঁয়া আর বালুুপাথর উত্তোলনে মাছের আশ্রয় ভেঙে পড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত বৃষ্টি ও হঠাৎ বন্যায় প্রজনন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

অনেক জেলে জানিয়েছেন, দিনভর জাল বুনেও খরচ ওঠে না। অনেক পরিবার এনজিও ঋণের কিস্তিতে ডুবে যাচ্ছে। মাছ ধরা পেশা ছেড়ে কেউ কেউ ভ্যান-রিকশা চালাচ্ছেন, কেউ দিনমজুরি করছেন, কেউবা মৌসুমি কাজের জন্য শহরে চলে যাচ্ছেন।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর জেলেপাড়ার জেলে বিনোদ চন্দ্র দাস (৫৫) বলেন, দুই বছর আগে মাছ ধরা বাদ দিয়েছি। এখন একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছি। পৈতৃক কর্ম ছেড়ে দেওয়ায় কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু আমার মতো অনেকে নিরুপায় হয়ে মাছ ধরা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

রাজারহাট উপজেলার জেলে কমলাকান্ত দাস (৬০) বলেন, জাল ও নৌকা মেরামত করতে যে টাকা খরচ করি মাছ ধরে সেই টাকাই তুলতে পারি না। প্রতিবছর ঋণ নিতে হয়। আগে নদীতে মাছ পেতাম আর এতে আমাদের সংসার  সচ্ছলভাবে চলতো। এখন সে উপাই নেই। 

তিনি অভিযোগ করেন, নদীতে মাছ ধরার পেশা এখন অপেশাদারদের কাছে চলে গেছে। তারা অনেক টাকা বিনিয়োগ করে অবৈধ কারেন্ট ও চায়না জাল দিয়ে মাছ ধরেন।

জেলে নবীন দাসের স্ত্রী সুলেখা দাস (৪৫) বলেন, এখন মাছ ধরা মানে খিদে থাকা। আগে প্রতিদিন মাছ খেতাম, এখন সপ্তাহে একদিনও জোটে না। সংসার চলছে খুব কষ্টে।

তিস্তা ব্যারাজ এলাকার মৎস্যজীবি আব্দুল খালেক (৬৫) জানান, গেল ৪০ বছর ধরে তিন্তা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিস্তা নদী থেকে মাছ যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাতে আগামি কয়েকবছর পর এ নদীতে মাছ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। বর্ষাকালে গড়ে প্রতিদিন ৬০০-৭০০ টাকা উপার্জন করি কিন্তু শুস্ক মৌসুমে তা ৩০০ টাকার নিচে নেমে যায়।  

এ বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে তিস্তায় আবারও মাছ ফিরতে পারে। এ জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি বলেন, অবৈধ জাল নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। খাল-বিল পুনঃসংযোগ করে প্রজনন ক্ষেত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন জাতের দেশি ছোট মাছ সতর্কভাবে নদীতে ছাড়তে হবে। বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ কমাতে হবে এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ন্যূনতম পরিবেশগত প্রবাহ চুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

রংপুর বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক আয়না হক জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পর্যাপ্ত প্রবাহ ছাড়া কোনো উদ্যোগ সফল হবে না। তিস্তা নদীকে নদীর মতো চলতে দিতে হবে। তবে তিস্তা নদীতে মাছ ফিরিয়ে আনতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা চলছে।