শিরোনাম

\ এনামুল হক এনা \
পটুয়াখালী, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন থমকে যায় পটুয়াখালীর স্বাভাবিক গতি। ব্যস্ত সড়ক, চায়ের দোকানের আড্ডা, দলীয় কার্যালয়ের কোলাহল—সবকিছুর ভেতর নেমে আসে এক গভীর নীরবতা।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন ও দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকাল শুধু একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, পটুয়াখালীর মানুষের কাছে তা যেন হারিয়ে যাওয়া এক স্মৃতিময় সময়ের দরজা খুলে দেয়। শোকের ভারে নুয়ে পড়া এ জেলার রাজনীতি ও জনজীবনে হঠাৎ করেই ফিরে আসে প্রায় ২৫ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দিন—২০০১ সালের নির্বাচনী সফরের স্মৃতি।
দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার পটুয়াখালী আগমন ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। সে সময় আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা যেমন ছিল সীমিত, তেমনি ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা ও প্রত্যাশার চূড়ান্ত পর্যায়। নেত্রী আসবেন—এই খবরেই পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। সময়ের পর সময় পেরিয়ে গেলেও মানুষ অপেক্ষা ছাড়েনি। দীর্ঘ বিলম্ব, টানা বৃষ্টি কিংবা ক্লান্তি—কিছুই সেদিন মানুষের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে বাউফল উপজেলার ধুলিয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার পটুয়াখালী সফর। সেখান থেকে গাড়িবহরে জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। চারটি সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন, কথা বলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কোথাও নদীভাঙনের অভিযোগ, কোথাও দারিদ্র্েযর হাহাকার, কোথাও অবহেলার দীর্ঘশ্বাস—সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শোনেন তিনি। এই সরাসরি সংযোগই খালেদা জিয়াকে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে আলাদা করে তোলে।
পটুয়াখালীর পিডিএস মাঠে আয়োজিত জনসভাটি ছিল সেই সফরের কেন্দ্রবিন্দু। জনসমাগমে মাঠ ছাপিয়ে আশপাশের এলাকা পরিণত হয়েছিল মানুষের স্রোতে। অনেকেই মাঠে জায়গা না পেয়ে গাছে, বাড়ির ছাদে কিংবা উঁচু স্থানে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন কেবল একবার নেত্রীকে দেখার জন্য। বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্ট, নদীভাঙন ও উন্নয়ন বঞ্চনার কথা। তার কণ্ঠে প্রতিশ্রুতি আর সহমর্মিতা একাকার হয়ে সেদিন উপস্থিত জনতাকে আপ্লুত করেছিল।
আজ সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়েন অনেকেই। পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলামীন হাওলাদার জানান, তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। প্রিয় নেত্রীকে দেখার নেশায় বন্ধুদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলেন রিকশার ওপর। ভোরে গাছে উঠে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ঘটনাও তার স্মৃতিতে অম্লান। তার ভাষায়, সেদিন নেত্রীর কথা আর পটুয়াখালীর মানুষ নিয়ে তার ভাবনা আজও আমাকে নাড়া দেয়।
একই রকম আবেগের কথা শোনান জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শামীম চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশাল মিছিল নিয়ে পিডিএস মাঠে যাওয়া, গাছে উঠে দাঁড়িয়ে নেত্রীকে এক ঝলক দেখার মুহূর্ত—এসব স্মৃতি আজও চোখ ভিজিয়ে দেয়। রাজনীতির সঙ্গে আবেগ যে কতটা গভীরভাবে জড়িত হতে পারে, সেই উদাহরণ হয়ে আছে দিনটি।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান টোটন স্মরণ করেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সৌজন্যের কথা। ঢাকায় এক সাক্ষাতে তার পরিবারের খোঁজ নেওয়ার বিষয়টি যেমন মনে রেখেছেন, তেমনি মনে আছে পটুয়াখালী সফরের দিন টানা বৃষ্টিতে ভিজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। তার মতে, নেত্রীর প্রতি মানুষের সেই ভালোবাসা ছিল নিখাদ ও স্বতঃস্ফূর্ত।
আর জেলা বিএনপির সভাপতি সেনাংশু সরকার কুট্টি বলেন, সে সময় তিনি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে খালেদা জিয়া যেভাবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-কষ্ট মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন, তা রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত। নেত্রীকে এক নজর দেখার আশায় মানুষ দুই-তিন দিন আগেই মাঠে এসে অবস্থান নিয়েছিল—এমন দৃশ্য আজও চোখে ভাসে।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর গতকাল মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার জীবনাবসান ঘটে। তার মৃত্যুতে পটুয়াখালী জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো শোকসভা, দোয়া মাহফিল ও কালো ব্যাজ ধারণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
একটি রাজনৈতিক অধ্যায় শেষ হলেও পটুয়াখালীর মানুষের হৃদয়ে খালেদা জিয়া রয়ে গেছেন স্মৃতি, আবেগ আর প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে। শোকের এই সময়ে ২০০১ সালের সেই সফর যেন আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে—সময় পেরোলেও যা মুছে যায়নি, বরং আরও গভীরভাবে গেঁথে গেছে মানুষের মনে।