বাসস
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৫৬

সুনামগঞ্জে ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্বার স্বরণে নির্মিত ডলুরা শহীদ সমাধি

ছবি : বাসস

মুহাম্মদ আমিনুল হক

সুনামগঞ্জ, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): মেঘপাহারের দেশ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের ডলুরা গ্রামের নামেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণে নির্মিত হয়েছে ডলুরা শহীদ সমাধি। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের ডলুরা গ্রামটি জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। 

উপজেলার সীমান্তবর্তী জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ডলুরা গ্রামটির চারদিকে সবুজের সমারোহ। গাছগাছালির ফাঁকে ছোট ছোট ঘরবাড়ি-দোকানপাট। নদী ও সবুজ পাহাড়ের হাতছানি দেখে মন জুড়িয়ে যায়। ডলুরা শহীদ সমাধিতে আছে ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য’। পাশেই ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি তর্পণ কেন্দ্র’, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এবং দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য ‘ছায়াকুঞ্জ’। 

সারি সারি শহীদদের সমাধি দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আত্মত্যাগের গভীর বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের নামফলক রয়েছে প্রতিটি সমাধিতে। ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ৬ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাঁদের এখানে দাহ করা হয়। এই ৪৮ শহীদের মধ্যে অনেকেরই পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ছিল না।

সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রায় দেড় বছরে সুনামগঞ্জের ১২টি জেলার ২২টি উপজেলা ঘুরে ঘুরে শহীদদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়। আর এ কাজটি সম্পন্ন করেন, সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান এবং বীর মুক্তিযোদ্বা প্রয়াত মালেক হুসেন পীর। 

এ পর্যন্ত ৪৪ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা পেলেও এখনো ৪ জনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। তাঁদের শুধু নাম বা জেলার নাম আছে।

এই চারজনের তথ্য সংগ্রহের কাজ অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন, বীর মুক্তিযোদ্বা আবু সুফিয়ান।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের মৃতদেহগুলো ডলুরা এলাকায় এনে রাখতেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার মধু মিয়া। তাঁর বাড়ি এই ডলুরা এলাকাতেই। মধু মিয়া লেখাপড়া জানতেন না। তাঁর একটি ছোট্ট নোটবুক ছিল। যেটি এখন রয়েছে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। 

তিনি আরো জানান, মধু মিয়া ওই নোটবুকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, আবার কারও কারও ঠিকানা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে লিখিয়ে নিতেন। তবে অনেকেরই পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ছিল না। এভাবে মধু মিয়া ডলুরায় ৪২ জন মুসলমান মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সমাহিত এবং ৬ জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দাহ করেন। তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করতেন স্থানীয় কয়েকজনে।  

বীর মুক্তিযোদ্বা জানান, মুসলমান মুক্তিযোদ্ধাদের জানাজা পড়াতেন স্থানীয় ফেনিবিল গ্রামের বাসিন্দা তারু মুনসি। আর হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের দাহ করার সময় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতেন সীমান্তের ওপারের লালপানি গ্রামের বাসিন্দা নেপু ঠাকুর। 

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ জানান, মধু মিয়া ছিলেন বলেই যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে এভাবে এক জায়গায় ৪৮ জন বীর শহীদকে সমাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২০০৪ সালে ১৬ মার্চ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই শহীদ সমাধিকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে এটির দেখাশোনা করছিলেন ফেনিবিল গ্রামের আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা খোকা মিয়া। তিনিও মৃত্যুবরণ করেছেন।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, সুনামগঞ্জ মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে এই গণকবরকে ঘিরে শহীদ স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়। এটি দেখাশোনা করার জন্য প্লাটুন কমান্ডার মধু মিয়াকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। 

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শুরুতে স্মৃতিসৌধের চারদিকে ৫ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর এবং ৪৮ শহীদের একটি নামফলক নির্মাণ করে দেন ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এ এস হেলাল উদ্দিন। পরবর্তী সময়ে তাঁর অর্থায়নেই এখানে দর্শনার্থীদের জন্য রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালে জেলা পরিষদ ‘ছায়াকুঞ্জ’ নির্মাণ এবং ২০১১ সালে নির্মাণ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য ও মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ। 

পরবর্তীতে সদর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সমাধি এলাকার ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। প্রতিটি সমাধিকে নতুনভাবে পাকা করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানাসহ নতুন নামফলক। সমাধির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। পুরো এলাকা ঘিরে ‘মুক্তিযোদ্ধা উদ্যান’ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। 

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, প্রশাসনের উদ্যোগে এখানে পানির ব্যবস্থাসহ সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এ ‘মুক্তিযোদ্ধা উদ্যান’টি আরো সুন্দর করতে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।