শিরোনাম

/নুসরাত সুপ্তি/
নারায়ণগঞ্জ, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন প্রথম সূর্যের আলো আছড়ে পড়ে, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় কাইকারটেক হাটের কোলাহল।
কেউ ভ্যানে করে টেনে আনেন গৃহপালিত পশু-পাখি, কেউবা আবার রিকশায় করে মাছ ধরার জাল, জাল তৈরির সুতা, গৃহস্থালির সামগ্রী নিয়ে আসেন।
নারায়ণগঞ্জের আনাচে কানাচে থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়ে মুহূর্তেই জমে ওঠে হাট। দুই শতাব্দী পরেও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সারথি বয়ে বেড়াচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে গড়ে উঠা কাইকারটেক হাট।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য লালনকারী এই হাটটি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। প্রতি সপ্তাহের রোববারে বসে হাটটি। হাটকে কেন্দ্র করে এই এলাকার নামকারণ করা হয়েছে কাইকারটেক।
এ হাটের বটবৃক্ষগুলো যেন হাটের শত শত বছর বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাটের পরিবেশ ও ঐতিহ্যের টানে ক্রেতা বিক্রেতা ছাড়াও ভ্রমণকারীদের আনাগোনাও থাকে চোখে পড়ার মতো।
হাটে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বিশাল এক বটগাছ। তার কাছেই কয়েকশত বছর পুরোনো একটি ভাঙা দেয়াল। হাটে ঢুকতেই দেখা মেলে দেশের বেশকিছু দুষ্পাপ্য পণ্য।
হাটে বিক্রি হয় পশুপাখি, মাটির তৈজসপত্র, দা, বটি, কোদাল, নিড়ানি, শেকল, জাল, বরশি, বাঁশের চালুন, ডুলা, কুলা, সাঝি, মিষ্টিজাত খাবার, মৌসুমি শাক-সবজি সহ গাছের চারা, বেত, কাঠ, বাঁশ, নৌকা ইত্যাদি। প্রায় হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসপত্র স্মরণ করিয়ে দেবে কয়েক দশক পুরোনো মিলিয়ে যাওয়া স্মৃতি।
হাটে মাছ ধরার জাল বিক্রি করতে আসা বন্দর থানার হারুন বলেন, বর্ষা মৌসুমে জাল বেশি বিক্রি হয়। এখানে জালের দাম কিছুটা কম হওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা জাল কিনতে আসে। আমার কাছে কড়ি জাল, জাই জালসহ কয়কে ধরনরে জাল আছে। এসব জাল এক হাজার টাকা থেেক চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকি। গ্রামের বিলে জেলেরা মাছ ধরার কাজে এসব জাল ব্যবহার করেন।
হাটে প্রায় চার দশক যাবৎ লোহার তৈরি তৈজসপত্রসহ অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করেন হাসান মিয়া। তিনি বলেন, হাটের সেই আগের জমজমাট রূপ এখন আর নাই। এখন ঘরের কাছেই সব পাওয়া যায়। মানুষ আগের মতো হাটে আসতে চায় না। কিন্তু একসময় হাটে অনেক বেঁচাকেনা ছিল। সারা সপ্তাহ মানুষ অপেক্ষা করত, হাটের দিন আসলে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাট থেকে কিনবে। এখন হাটে আসি ঠিকই কিন্তু তেমন লাভ থাকে না।
কাইকারহাটে বিক্রি হওয়া মজার মজার খাবারের প্রধান আকর্ষণই হলো বিশেষ এক মিষ্টি। নাম ‘পুতামিষ্টি’, মিষ্টিটা দেখতে অনেকটা শিলপুতার মতো। তাই সবার কাছে মিষ্টিটা এই নামেই পরিচিত। এই হাটে অনেক মিষ্টিপ্রেমীরা দূর-দূড়ান্ত থেকে ছুটে আসেন শুধু এ মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য। আকার-আকৃতিতে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এই মিষ্টি অনেক বড়। একটা মিষ্টির ওজন আধা কেজি থেকে দুই কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। হাটে পুতামিষ্টি ছাড়াও তালের রস, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহসহ নানা পদের মিষ্টি থেকে শুরু করে দই, নানা পদ লোকজ খাবার এখানে পাওয়া যায়।
হাটের দোকানি সঞ্জয় ঘোষ পুতামিষ্টির ইতিহাস জানিয়ে বলেন, আমাদের কয়েক প্রজন্ম এই মিষ্টি বানানোর পেশাতেই আছি। সোঁনারগায়ের আনন্দ বাজারে দোকান আছে। সেখানে সারাবছর মিষ্টি বিক্রি করি। মিষ্টির সঙ্গে দই, পরোটা-ভাজিও বিক্রি করি।
শুধু মিষ্টি নয়, এই হাটে নৌকা ও ঘোড়া বিক্রি হয় বিশেষ বিশেষ সময়ে। হাট পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে এই হাটে নৌকা বিক্রি করা হয়। একই সাথে এই হাটে মাঝে মাঝে গৃহপালিত পশু-পাখিসহ ঘোড়া বিক্রেতারাও আসেন।
কাইকারটকে হাটরে ইজারাদার সামসুল ইসলাম হাটের অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি তুলনা করে বলনে, কাইকারটেক হাট শত বছর পুরোনো। এই হাটের গোড়াপত্তন কিভাবে হয়, তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারবে না। আমার বয়স এখন সত্তরোর্ধ্ব। আমার ছোটবলোয় এই হাটের যে জৌলুস ছিল সে অবস্থা এখন নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকে শুরু করে ঘোড়া, হাতিও এখানে একসময় বিক্রি হতো। তবে আমাদের হাটের মিষ্টি পুরোদেশে ব্যাপক পরিচিত। দূর-দূরান্ত থেেক এই হাট দেখতে আসে মানুষ।
কাইকারটকে হাট এখনো আমাদের অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক।