বাসস
  ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৯

নাটোরে বাহারি ফুলের নির্যাস থেকে শহিদুলের রঙিন চা

ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন

নাটোর, ২১ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): জেলায় বাহারি ফুলের নির্যাস থেকে পাওয়া যাচ্ছে রঙিন চা। লাল আর নীল রঙের নজর কাড়া এসব চায়ের আছে ভেষজ গুণ। তাই চাহিদা বাড়ছে ক্রমশ। আর এই সফলতার কাহিনি তৈরি করেছেন দেশের একমাত্র ভেষজ পল্লীর আদর্শ ভেষজ উৎপাদক ও প্রক্রিয়াজাতকারী মো. শহিদুল ইসলাম।

দেশের একমাত্র ভেষজ পল্লী নাটোরের লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া এলাকার খোলাবাড়িয়া হাজীগঞ্জ বাজার ভেষজ উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম তার আবাদি জমিতে অ্যালোভেরা, শিমুল, অশ্বগন্ধা, শতমূলসহ বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ঝরনা ছেটানো সেচ পদ্ধতির উদ্ভাবন ছাড়াও বৈচিত্র্যময় তার কর্মপরিধি। 

২০১৭ সালে রংপুর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে চারা সংগ্রহ করে শুরু করেন রোজেলা গাছের চাষ। এই গাছের ফুল থেকে তৈরি হয় রোজেলা চা। লাল রঙের রোজেলা চা এখন সারাদেশে সমাদৃত।

দেশে রোজেলা চা উৎপাদনে নাটোরের শহিদুল অন্যতম পথিকৃৎ। ২০১৭ সালে মাত্র পাঁচ শতক জমিতে রোজেলা চায়ের চাষাবাদ করলেও বর্তমানে আবাদ বেড়ে হয়েছে দশ বিঘা। শহিদুলের দেখানো পথে ভেষজ পল্লীর অনেকেই এখন রোজেলা চাষ করেন। 

একবিঘা জমিতে সারিবদ্ধ করে রোপণ করা যায় দেড় হাজার গাছ। জুন মাসে চারা রোপণ করার পরে নভেম্বর থেকে শুরু হয় ফুলের বৃতি আহরণ, চলে ডিসেম্বর পেরিয়ে জানুয়ারি পর্যন্ত। এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত রোজেলা ফুলের বৃতি প্রক্রিয়াজাতকরণের পরে পাওয়া যায় ১০০ কেজি চা।

সংগৃহীত ফুলের বৃতি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে শুকনো ফুলে রুপান্তর ঘটে। সাধারণত এক কেজি ফুল থেকে ২০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত ফুল পাওয়া যায়। এক কেজি খোলা রোজেলা চায়ের দাম দেড় হাজার টাকা আর সমপরিমাণ প্যাকেটের দাম আড়াই হাজার টাকা। পঞ্চাশ গ্রাম খোলা চায়ের দাম একশ’ টাকা আর সমপরিমাণ প্যাকেটের দাম দেড়শ টাকা। পঞ্চাশ গ্রাম ফুল থেকে তৈরি করা যায় রক্ত রঙের হালকা টক স্বাদের ২৪ কাপ চা!

জার্নাল অব নিউট্রিশনের গবেষণায় রোজেলা উচ্চ রক্তচাপ কমায়, পাইথোমেডিসিনের গবেষণায় রোজেলা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে, ফুড অ্যান্ড কেমিক্যাল টক্সিকোলজির গবেষণায় রোজেলা লিভারের সুরক্ষা দেয়, ফুড অ্যান্ড ফাংশনের গবেষণায় রোজেলা ওজন কমাতে সাহায্য করে, জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড কেমিস্ট্রির গবেষণায় রোজেলা এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কোষের সুরক্ষা দেয়, ফার্মাকগনোজি রিসার্চের গবেষণায় রোজেলা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে।

ভেষজ গবেষক মো. শহিদুল ইসলাম কাঁঠালবাড়িয়াতে আবাদি জমির প্রান্তে গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন অপরাজিতার ঝাড়। সবুজ পাতার রাজ্যে প্রতিনিয়ত ফুটছে অপরাজিতা ফুল, তবে বর্ষায় ফোটে সর্বাধিক। এসব ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে অপরাজিতার চায়ে। মাত্র ছয় মাসের চেষ্টায় চার কেজি প্রক্রিয়াজাত অপরাজিতা ফুলের চা উৎপাদনের সক্ষম হয়েছেন তিনি। প্রতি কেজি’র বিক্রয় মূল্য চার হাজার টাকা। পঞ্চাশ গ্রাম প্যাকেটের অপরাজিতা ফুলের চায়ে একশ’ কাপ চা প্রস্তুত করা যায়।

স্বাদে একটুখানি তেতো গারো নীল রঙের চা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রে জানা যায়, অপরাজিতা ফুলের নির্যাস রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডস্, কোলেস্টেরল ও এরডিএলের পরিমাণ কমিয়ে দেয় বলে হৃদ্‌রোগে উপকারী। এই ফুলে বিদ্যমান স্যাপোনিন ও ফ্লাভোনোয়েড অ্যাজমা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে, অ্যান্থোসায়ানিন ফ্রি রেডিকেল তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ক্যানসার প্রতিরোধ করে, পলিফেনল ও ফ্লাভোনোয়েড লিভার এনজাইমের মাত্রা কমিয়ে লিভার সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে।

কাঁঠালবাড়িয়া বাজারে শহিদুল ইসলামের রকমারি চায়ের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিক্রয়কেন্দ্র। মেডিকা টি এন্টারপ্রাইজের নামে বিপণনকৃত রোজেলা গরম পানীয়’র জন্যে প্রক্রিয়াজাত ফুল বিসিএসআইআর কর্তৃক পরীক্ষিত এবং বিএসটিআই অনুমোদিত। 

‘মূলত অনলাইনে সারাদেশে রোজেলা চায়ের বিপণন করি, এছাড়া বীজ থেকে তৈরীকৃত চারাও বিক্রি করছি’,বলেন মো. শহিদুল ইসলাম। একইভাবে অপরাজিতার ফুল থেকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে অপরাজিতা চা। এছাড়া বাসক পাতা থেকে কালো রঙের বাসক চা এবং তুলশী পাতা থেকে সবুজাভা তুলশী চা।

আদর্শ ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ রোজেলা বৃতি থেকে উৎপাদিত রোজেলা চা ছাড়াও অপরাজিতা ফুলের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত অপরাজিতা চা এবং বাসক পাতা থেকে প্রাপ্ত বাসক চা আর তুলশী পাতা থেকে প্রাপ্ত তুলশী চায়ের উৎপাদন ও বিপণন পরিধি বৃদ্ধি করতে চাই। এসব উপকারী গরম পানীয় জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে চাই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বাসস’কে বলেন, আদর্শ ভেষজ উৎপাদক মো. শহিদুল ইসলাম বৈচিত্র্যময় উৎপাদন ও উন্নয়নে অনন্য। আমার প্রত্যাশা থাকবে, তিনি তার উদ্ভাবনী কর্মের মাধ্যমে আগামীতে আরো এগিয়ে যাবেন।