শিরোনাম

বেলাল রিজভী
মাদারীপুর, ২৯ অক্টোবর ২০২৫ (বাসস) : প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। ঘর সাজাতে একসময় বেতের তৈরি চেয়ার, টেবিল, সোফাসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ছিল স্থানীয় মানুষের গর্বের বিষয়। আর এখন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে সস্তা প্লাস্টিক ও স্টিল পণ্যের আধিপত্যে।
বেত শিল্পের স্থানীয় কারিগরেরা জানান, আগে নদী-নালা ও বনাঞ্চল ঘেঁষা গ্রামগুলোতে সহজেই বেত পাওয়া যেত। স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা কাঁচামাল দিয়েই তারা নানারকম আসবাবপত্র ও শৌখিন সামগ্রী তৈরি করতেন। এখন সেই বেত সচরাচর পাওয়া যায় না, সংগ্রহ করতে হয় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। আর এতে খরচ বাড়লেও বিক্রি বাড়েনি। কাঁচামালের অভাব ও বাড়তি খরচের কারণে বেতের পণ্য তৈরি করে আর আগের মতো এখন লাভ হয় না। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই পেশা ছেড়ে অনেকেই এখন অন্য কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি গ্রামের কারিগর নারায়ণ চন্দ্র বলেন, আগে আমরা গ্রামে ঘুরে ঘুরে বেত সংগ্রহ করতাম। এখন বেত মেলে না, আর যা পাওয়া যায় তা বেশি দামে কিনে আনতে হয়। দাম বেড়েছে, অথচ চাহিদা কমে গেছে।
মিঠাপুর গ্রামের বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগর হাঁসু মল্লিক ক্ষোভের সাথে বলেন, প্লাস্টিকের আধিপত্য বেত শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্লাস্টিকের পণ্য আজকাল কম দামে পাওয়া যায়। বেতের পণ্যসামগ্রী এখন প্লাস্টিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না। বেতের চেয়ার, টেবিল, সোফাসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী তৈরি এবং বিক্রি করে ছেলে মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার চালানো এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই এ শিল্পের অনেকে এখন এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
সরেজমিনে মাদারীপুর শহরের পাবলিক লাইব্রেরির পাশে শিবচরের অভিজ্ঞ কারিগর বেল্লাল বেপারীর ‘সুইট হোম’ নামের দোকানে গিয়ে দেখা মেলে ঐতিহ্যবাহী বেতের সুনিপুণ কারুকাজে তৈরি ম্যাগাজিন র্যাক, চেয়ার, সোফাসেট, ট্রলি, ফোল্ডিং চেয়ার, ডাইনিং চেয়ার, বেবি কট ও নবাব সেটসহ নানা পণ্য। বেল্লাল বেপারী, যিনি চার দশক ধরে বেত শিল্পে যুক্ত। তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি বেতের আসবাবপত্র তৈরি করে আসছেন। তার দোকানে স্থানীয়সহ আশেপাশের জেলা থেকে আগে অনেক ক্রেতা আসতো। কিন্তু এখন বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিনি বলেন, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান আর খাগড়াছড়ি থেকে অনেক খরচে বেত কিনে আনি, কিন্তু বিক্রি তেমন হয় না। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে বেশি দামে বেত কিনে এনে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি সহায়তা না পেলে এই পেশা টিকবে না।
স্থানীয় ব্যবসায়ী রিপন মিয়া বলেন, এক সময় এই পণ্যের প্রচুর চাহিদা ছিল। এখন প্লাস্টিকের জোয়ারে বাজার হারিয়েছে বেত শিল্প। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন।
কালকিনির আরেক কারিগর সহিদুর রহমান জানান, বেত আনার খরচ, শ্রম ও তৈরির ঝামেলায় লাভ থাকে না। আগের মতো আর চলে না।
কারিগরদের মতে, উৎপাদন খরচ ও বাজার দামের সমন্বয় না থাকায় নতুন প্রজন্ম আর এই পেশায় আগ্রহী নয়। ফলে ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, মাদারীপুরের বেত শিল্প শুধু একটি পেশা নয়, এটি জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। সময়মতো সরকারি সহযোগিতা ও উদ্যোক্তারা না এগিয়ে এলে এই ঐতিহ্য একদিন পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে।
রাস্তি গ্রামের প্রবীণ কারিগর যশোধর মন্ডল আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের হাতে গড়া বেতের চেয়ার একসময় বিয়ের উপহার হিসেবে যেত গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। আর এখন সেই বিয়েতে উপহার যায় প্লাস্টিকের চেয়ার।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা, সহজ ঋণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলে মাদারীপুরের এই ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্প আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
এ বিষয়ে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, “বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে। কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বাড়ানো হবে, যেন তারা বেতের পাশাপাশি বিকল্প পণ্যে কাজ করতে পারেন।”