বাসস
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১:৫৮

কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কটিয়াদী ঢাকের হাট 

ছবি : বাসস

এস কে রাসেল

কিশোরগঞ্জ, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (বাসস) : শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হচ্ছে আমামিকাল।দেশের বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে পূজামণ্ডপগুলো সেজেছে রঙ, আলো আর প্রতিমার আভায়। কিন্তু কটিয়াদীর এককোণে, আড়িয়াল খাঁ নদপাড়ে পূজার প্রস্তুতিকালে থাকে আলাদা কোলাহল। এখানে প্রতিবছর বসে বিখ্যাত ঢাকের হাট- যেখানে বাদ্যযন্ত্র নয়, ভাড়া হয় বাদক দল।

কটিয়াদীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট শুধু বাদক বা ঢাকিদের ভাড়া নেয়ার জায়গা নয়, বরং এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতি। 

সরেজমিন হাটে দেখা যায়, একপাশে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, সানাই, বাঁশি, খঞ্জরি, করতাল—সব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিজেদের নৈপুণ্য দেখাচ্ছে দলগুলো। অন্যপাশে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন পূজারি ও আয়োজকরা। কার তাল কত নিখুঁত, কার বাজনায় দেবীর আগমন আরো মহিমান্বিত হবে—এই পরীক্ষার ওপরই নির্ভর করছে চুক্তির অঙ্ক। দাম উঠছে ১০ হাজার থেকে দুইলাখ টাকা পর্যন্ত।

এই হাটে বাদকেরা আসেন, বাজিয়েই তারা সংসার চালান। মুন্সিগঞ্জ থেকে সাতজনের দল নিয়ে এসেছেন হরি রাজ। তার কণ্ঠে আনন্দ আর অভিমান। তিনি বলেন, “৩০ বছর ধরে আসছি। পরিবার ছেড়ে আসতে হয়, কষ্ট হয়। তবুও ঢাকই আমাদের রুটি-রুজি।”

এখানে কারও স্বপ্ন পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো, কারও লক্ষ্য নতুন জামাকাপড় বা সন্তানের পড়াশোনার খরচ। কুমিলা থেকে ৮জনের দল নিয়ে এসেছেন মোহাম্মদ আলী। তিনি জানালেন, তাদের লক্ষ্য ৯০ হাজার টাকার চুক্তি। 

সজীব দাসের দল এসেছে মুন্সীগঞ্জ থেকে, তাদের দাবি এবার একলাখ বিশহাজার টাকা। তিনি মনে করেন আগেরমতো জৌলুশ নেই হাটে। 

এ হাটের জন্মেও ইতিহাস জানান স্থানীয়রা। তারা জানান, ষোড়শ শতকে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় দুর্গাপূজার জন্য ঢাকিদের খুঁজতে বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) বার্তা পাঠাতেন। নৌকায় নৌকায় ঢাকি এসে ভিড়ত ব্রহ্মপুত্রের যাত্রাঘাটে। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে শুনতেন, সেরা দলকে দিতেন পুরস্কার। সেই আয়োজনই ধীরে ধীরে রূপ নেয় হাটে, যা পরে স্থান বদলিয়ে আসে কটিয়াদীর পুরাতন বাজার এলাকায়। আজও সেই ঐতিহ্য বেঁচে আছে। শুধু পূজার আয়োজন নয়, এটি হয়ে উঠেছে মিলনমেলা। ঢাকের তালে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা—তাক দুম, তাক দুম বাজে, যেন নদীপাড়ের বাতাসও দুলে ওঠে সুরে। 

এ হাটে পূজারিদের ভিড় লক্ষ্য করার মতো। একজন জানালেন, প্রতিবছর পূজার সময় ঢাকি ছাড়া মণ্ডপ কেমন যেনো ফাঁকা লাগে। তাই এবার নরসিংদী থেকে কটিয়াদীর ঢাকের হাটে এলাম ঢাকি ভাড়া করতে। এখানকার ঢাকিদের বাজনা আলাদা আবেগ জাগায়। দাম একটু বেশি হলেও ভালো দলের জন্য আমরা রাজি আছি, কারণ দেবীর আরাধনা ঢাকের তালে তবেই পূর্ণ হয়।

মিঠামইন থেকে নারায়ণ সূত্র ধর এসেছেন ঢাকি ভাড়া করতে। বললেন, ‘প্রতিবছর এখান থেকেই ঢাকি নিই’। 

কিশোরগঞ্জ শহরের দীপেন ভৌমিক প্রথমবার এসেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক শুনেছি ঢাকের হাটের নাম। এবার নিজে দেখলাম, ঢাকি দলও নিলাম। ’

স্থানীয় কৃষ্ণধন গোস্বামী জানান, যখন দেবী দুর্গা প্রতিমায় আসন নেবেন, তখন এই ঢাকিদের সুর আর তালের ছন্দেই পূর্ণ হয় পূজার আনন্দ। কয়েক শতাব্দী ধরে এই হাট এলাকাবাসীর সহযোগিতায় টিকে আছে। 

কটিয়াদী পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনি কুমার সাহা জানান, এ হাট ধর্ম-বর্ণের সীমা ছাড়িয়ে বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ছয়শ’ ঢাকি আসেন। যারা চুক্তিবদ্ধ না হয়ে ফেরেন, তাদের বাড়ি যাওয়ার ভাড়া দেওয়া হয়।

এ হাটের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করে পুলিশ। কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তরিকুল ইসলাম জানান, বাদক ও পূজা আয়োজকদের নিরাপত্তায় মোবাইল টিম নিয়োজিত আছে।