বাসস
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:১০

চরফ্যাশনে পৌরসভার শতকোটি টাকার জমি উদ্ধারে অভিযান

ভোলার চরফ্যাশন পৌরসভার বেহাত শতকোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধারে ইউএনও'র সাঁড়াশি অভিযান শুরু। ছবি: বাসস

॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥

ভোলা, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার সর্বদক্ষিণের উপজেলা চরফ্যাশন পৌরসভার বেহাত শতকোটি টাকা মূল্যের জমি উদ্ধারে ইউএনও'র সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। বিগত আওয়ামী স্বৈরশাসক জমানায় চরফ্যাশন শহরে পৌরসভার মালিকানাধীন মূল্যবান ১৫ শতাংশ জমি সেখানকার সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের লোকজনের দখলে ছিলো। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যায়ভাবে তৎকালীন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ওই সাংসদ তার চেলাচামুন্ডাদের মাঝে জমিগুলো ভাগকরে দেয়ার পর সেখানে তারা মার্কেট নির্মাণ করে জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো।

গত ২৪' এর জুলাই বিপ্লবের পর ওইসব দখলবাজরা পালিয়ে গেলেও পুরনো দূর্বৃত্তদের সেই ভূমিসন্ত্রাস জার্সি বদল করে নতুন মোড়কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এরা পৌরসভার জমিতে নির্মিত ১২ টি চলমান দোকানসহ পুরো একটি মার্কেট ফের নিজেদের দখলে নিয়ে যায়। সেখানকার পৌরসভার বেহাত এমন বহু সম্পত্তি পুরনো ভূমিদস্যুদের হাত বদল হয়ে নতুন দস্যুদলের কব্জায় চলে আসে। ফলে সরকারের বেহাত ওইসব সম্পত্তি উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। আর এমন পদক্ষেপ নেয়ায় পৌর প্রশাসক ও ইউএনওকে বেকায়দায় ফেলতে মাঠে নেমেছেন ভূমিখেকো দখলবাঁজরা।

সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে গেলে চরফ্যাশন পৌর কর্তৃপক্ষ ও শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে আলাপকালে তারা গণমাধ্যমের কাছে পৌর সম্পত্তি দখল সন্ত্রাসের এমন চাঞ্চল্যকর বহু ঘটনা তুলে ধরেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জুলাই বিপ্লবের পর চরফ্যাশন পৌরসভার সেই বেদখল জমি উদ্ধার নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। স্বার্থান্বেসী মহল রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে থানা মসজিদ সংলগ্ন সোনালী পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে পৌরসভার জমিটি ফের দখল করেছে। সেখানে ফ্যাসিস্ট আমলের দখলবাজদের ১২টি আধাপাকা টিনসেড দোকান নির্মাণ করা আছে। মার্কেটের দোকানগুলো হাত বদল হওয়ার পর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ভাড়া নিয়ে সেখানে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। জানা যায়, গত ৫ আগস্টের আগে পৌর সম্পত্তিটি আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে সেগুলো এখন অন্যদের দখলে। 

পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, এটি নিয়ে পূর্ব থেকেই আদালতে একটি মামলা ছিল। জমিটি সরকারি খাস সম্পত্তি হওয়ায় বিগত ২০১৪-১৫ইং অর্থবছরে সুপ্রিম কোর্ট এটি চরফ্যাশন পৌরসভার তত্ত্বাবাধনে দেন। সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে ৪৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে সেখানে কিচেন মার্কেট নির্মাণের জন্য টেন্ডার আহ্বান করেন।

টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ৪২ লাখ ৪১ হাজার টাকায় কাজটি লটারির মাধ্যমে মেসার্স ইব্রাহীম ডাকুয়া এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত হন এবং গত ১৫ জুন সেটির কার্যাদেশও দেয়া হয়। কিন্তু অবৈধ দখলদারদের কারণে এখনো কিচেন মার্কেটের কাজ শুরু করতে পারেনি ওই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। পৌর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই তাদের বেহাত ওই সম্পত্তি ছেড়ে দিতে দখলবাজদের নোটিশ দিয়েছেন। তবুও এসব দখলবাজরা যেনো প্রশাসনের সেই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। তারা সরকারি সম্পত্তি নিজেদের কব্জায় রাখতে বিভিন্ন জায়গায় দৌঁড়ঝাঁপ করছেন। তারা উল্টো কিচেন মার্কেট তৈরির টেন্ডারের ৪৪ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে পৌর কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন।

এ বিষয়ে চরফ্যাশন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ন আহ্বায়ক ও মুদি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আব্দুস সাত্তার মিঠু গণমাধ্যমের কাছে বলেন, পৌরসভার এই জমিটি আ' লীগের লোকেরা এতোদিন ভাগাভাগি করে খাচ্ছিলো। দেশের পটপরিবর্তন হলে এ সম্পত্তি এখন হাত বদল হয়ে অন্যদের কাছে চলে যায়। 

এদিকে এ বিষয়ে ওই কিচেন মার্কেট নির্মানের ঠিকাদার ইব্রাহিম ডাকুয়ার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, টেন্ডার দেয়ার নামে যে লুটপাটের বিষয়টির প্রচার করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। পৌরসভার বেহাত জমির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়ায় এখনো কাজ শুরু সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষ যখনই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে আমাদেরকে জমিটি বুঝিয়ে দিবে, তখনই আমরা কাজ শুরু করবো।

এ বিষয়ে চরফ্যাশন পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামীম আহমেদ বাসস'কে বলেন, সোনালি পুকুর পাড়ে পৌরসভার শত কোটি টাকা মূল্যের খাস জমি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল দখল নিয়ে যে-যার যার মত অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে পরিবেশ নষ্ট করছিলো। এ নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন।

রিট শুনানীতে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে বাজারের ওই জমিটি চরফ্যাশন পৌরসভাকে দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়ত্ব দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি আদেশ প্রকাশ করেন। 

তিনি আরও বলেন, সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা অবৈধ দখলদারদের জায়গাটি খালি করে দিতে একাধিকবার নোটিশ প্রদান করেও কোনো ফল পায়নি। তাই উন্নয়নের স্বার্থে ওই স্থানে একটি কিচেন মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয় পৌরসভা। সেই অনুযায়ী চলতি ২০২৫ ইং সালের জুন মাসে একটি ইজিপি টেন্ডার আহ্বান করা হয়।

তিনি বলেন, পৌর প্রশাসক ও ইউএনও'র শক্ত হস্তক্ষেপে আমরা অভিযানের মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের সকল প্রস্তুতি নিয়েছি।

চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং পৌর-প্রশাসক রাসনা শারমীন মিথি এ বিষয়ে বাসস'কে বলেন, পৌরসভার সোনালী পুকুর পাড়ের ওই জমিটি পৌরসভার নামীয় জমি। এ জমিতে অবৈধভাবে মার্কেট নির্মাণ করে তা বাজার সমিতির নামকরে দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য নির্মিত স্থাপনা ভেঙ্গে সেখানে পৌরসভার অর্থায়নে একটি আধুনিক কিচেন মার্কেট নির্মাণ করার লক্ষ্যে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। সরকারের এ খাস জমি পৌরসভার আয়ত্বে রাখার উদ্দেশ্যে এ মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে পৌর মার্কেট তৈরি করা না হলে এ জমি ফের বেদখল হয়ে যাবে এবং পৌরসভা তার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে।