বাসস
  ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:১৮

বিচার বিভাগের জন্য প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার ১ বছর আগামীকাল

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ফাইল ছবি

ঢাকা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বিচার বিভাগের জন্য প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছরপূর্তি আগামীকাল।

প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতা আনয়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম আজ শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিচার বিভাগের জন্য প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছরের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর অভিভাষণ প্রদান করেন প্রধান বিচারপতি।

অভিভাষণ প্রদান অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ, বিচার বিভাগ সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অ্যাটর্নি-জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সেক্রেটারিসহ সারাদেশ থেকে আগত জেলা আদালতের বিচারকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান বিচারপতি তার অভিভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেন, যাতে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণের বিষয়ে বিশদভাবে তুলে ধরেন। এ রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অর্থপূর্ণ সংস্কার নিশ্চিতে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি।

বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত বছরের ১১ আগস্ট বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বিচার বিভাগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের বিচারকদের উদ্দেশ্যে দেওয়া অভিভাষণে রোডম্যাপ তুলে ধরেন।

আগামীকাল প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি তার অভিভাষণে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার যথাযথ প্রতিপালনসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনয়নে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন।

বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দকরণ, অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরেন। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশসমূহের ন্যায় সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, সকল প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে দেশে সুবিচারের সংস্কৃতির উন্মেষ- এই লক্ষ্যসমূহকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন।

তারই সূত্র ধরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে রোডম্যাপ ঘোষণার তারিখ হতে গত এক বছরে বিচার বিভাগে যে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা শুধু নিছক নীতিগত কাগজে কলমের পরিবর্তন নয়; বরং তার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিচার বিভাগের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের কার্যকর বাস্তবায়নে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

প্রধান বিচারপতি তার ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে তথা স্বচ্ছতা, দক্ষতা, জবাবদিহিতামূলক জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা বিনির্মাণে যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তার  বিবরণ তুলে ধরা হলো-

উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রণয়ন : ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যে সকল প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় তা গভীরভাবে বিশ্লেষণপূর্বক এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ-এর খসড়া প্রস্তুত করে খসড়াটি সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিবৃন্দের মতামত গ্রহণ করে খসড়াটি গত ২৮ অক্টোবর প্রস্তাব আকারে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে উপদেষ্টা পরিষদে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন হয় এবং ২১ জানুয়ারি অধ্যাদেশটি পাস হয়। ইতোমধ্যে এ অধ্যাদেশের আওতায় প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ‘সুপ্রীম জুডিসিয়াল এপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠন করা হয় এবং এই কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতির  সভাপতিত্বে  ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল এপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ অধ্যাদেশে অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়ার যথাযথ অনুসরণপূর্বক সম্পূর্ণ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেধা, দক্ষতা ও সততার নিরিখে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নব দিগন্তের সূচনা করেছে।

সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় : বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং Rules of Business I Allocation of Business এর সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া, সংবিধানের ৪র্থ তফসিলের অন্তর্গত ‘অন্তবর্তীকালীন ও সাময়িক বিধানাবলী’র দফা ৬(৬) অনুযায়ী অধস্তন আদালত সম্পর্কিত সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের বিধানাবলী যথাশিগগির সম্ভব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই এ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।  গত ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি রিট মোকদ্দমায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের জন্য সরকারকে নির্দেশনা প্রদান করেছে।  অন্তবর্তীকালীন সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো প্রস্তুতকরণে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

বিচার সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা আনয়নে ১২ দফা নির্দেশনা ঘোষণা :
যতদ্রুত সম্ভব বিচার বিভাগ হতে সকল প্রকার দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকল্পে প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর হতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সেবার মানোন্নয়নে প্রধান বিচারপতি গত ১৮ সেপ্টেম্বর ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন এবং সেই হতে ১২ দফা নির্দেশনার যথাসম্ভবরূপে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে প্রতি মাসে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে মনিটরিং সভা নিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে। এ সভায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ তাদের নিজ নিজ দপ্তর কর্তৃক সেবা সহজিকরণে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতিকে রিপোর্ট করে থাকেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ন্যায় জেলা আদালতসমূহেও অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশের বিচার বিভাগে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।

পেপার ফ্রি বেঞ্চ চালু :
প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বিচারসেবাকে জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত ২ জানুয়ারি হতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানী সংক্রান্ত একটি বেঞ্চে সম্পূর্ণ কাগজমুক্ত (paper free) বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব তত্ত্বাবধায়ন ও উদ্ভাবনে ওই বেঞ্চের সকল কাগজাদি অনলাইনে জমা প্রদানের অনলাইন প্লাটফর্ম (online platform) প্রস্তুত করা হয়েছে। পরবর্তীতে বিগত ২০ জুলাই  হাইকোর্ট বিভাগের অপর একটি কোম্পানি বেঞ্চে কাগজমুক্ত (Paper Free) বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বেঞ্চসমূহেও পেপার ফ্রী কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের রয়েছে।

লিগ্যাল এইড প্রদানে ক্যাপাসিটি টেস্ট চালু :
গত ২৫ আগস্ট ২০২৪  প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশনা প্রদান করা হয় যে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত আদালতে উপস্থিত সকল আসামীদের আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা আবশ্যক বিধায় আদালতে উপস্থিত আসামীদের কেউ যেন আইনগত সহায়তা বঞ্চিত না থাকেন তা নিশ্চিত করতে অধস্তন আদালত/ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত আসামীর পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকলে ওই আসামীর জন্য লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল থেকে আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে আদালতে উপস্থিত কোনো আসামীর পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত থাকলে ওই আইনজীবী যেন নির্বিঘ্নে ও বাধাহীনভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহযোগিতা করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক জারীকৃত ওই বিজ্ঞপ্তির ধারাবাহিকতায় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা কর্তৃক জারীকৃত এক পত্রে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০২৪ এর অনুচ্ছেদ ২ এর উপ-অনুচ্ছেদ (১) (থ) এর বরাতে উদ্ভুত কোনো বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আদালতে উপস্থিত আসামী যদি কোনো আইনজীবী নিযুক্ত করতে না পারেন তাহলে ওই আসামীকে অসমর্থ ব্যক্তি হিসেবে গণ্যক্রমে লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল হতে আইনজীবী নিয়োগ করার মাধ্যমে আইনগত সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা হয়। প্রধান বিচারপতির গৃহীত এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং জাতীয় আইনগত প্রদান সংস্থা এ বিষয়ে সারা দেশের লিগ্যাল এইড অফিসকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেছে।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ :
বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা প্রণয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষিতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭ রহিতক্রমে গত ২৮ জুলাই  বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়।

দেওয়ানী ও ফৌজদারী এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত চালুকরণের উদ্যোগ :
প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়ানী ও ফৌজদারী এখতিয়ার অনুসারে পৃথক আদালত স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি এবং সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেওয়ানি ও ফৌজাদারী এখতিয়ার অনুসারে জেলা জজশীপ ও সেশনস ডিভিশন পৃথককরণ এবং সংশ্লিষ্ট জজশীপ ও সেশনস ডিভিশনের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃজনে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত একটি পত্র গত ২১ এপ্রিল  আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করা হয়। বর্তমানে দেশের অধস্তন আদালতসমূহে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ দেওয়ানি আপীল, দেওয়ানি রিভিশন, ফৌজদারী আপীল, ফৌজদারী রিভিশন এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এর ফলে বিচারকের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত মামলা নিষ্পত্তি কার সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে মামলা জট ও দীর্ঘসূত্রিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হচ্ছে।

এরই প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে পৃথক এখতিয়ার প্রয়োগের সুবিধার্থে এবং মামলা জট নিরসনের নিমিত্ত বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করে পৃথক আদালত স্থাপন ও প্রয়েজনীয় সংখ্যক পদ সৃজন করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।  প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগে ফলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৪ হতে দেশের প্রতিটি জেলায় পৃথক দায়রা বিভাগ পুনর্গঠন করা সংক্রান্ত সরকারী প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়।

প্রধান বিচারপতি ফেলোশীপ চালুকরণ :
প্রধান বিচারপতি তার রোডম্যাপ বক্তব্যে বিচার বিভাগে মেধার বিকাশসহ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি ফেলোশীপ চালু করার ঘোষণা দেন। তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রধান বিচারপতি ফেলোশীপ নীতিমালার একটি খসড়া প্রস্তুতক্রমে বিগত ২০ ফেব্রুয়ারি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

অধস্তন আদালতের বিচারকগণের সংখ্যা বৃদ্ধি :
দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচার সেবায় বিচারপ্রার্থী জনগণের অভিগম্যতা বৃদ্ধিতে প্রধান বিচারপতি অধস্তন আদালতের বিচারকগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধান বিচারপতির আন্তরিক তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫ এর অধীনে গঠিত সার্ভিসের বিচারিক পদ সৃজনে গঠিত কমিটি এ বিষয়ে ইতোমধ্যে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কমিটির গত ২ সেপ্টেম্বরের এক সভায় সিদ্ধান্তের আলোকে ইতোমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১ টি পদসহ  মোট ২৩২ টি পদ সৃজিত হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ আদালত, সিটি কর্পোরেশনের বিচারিক পদে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ২৭ ফেব্রুয়ারি ও  ১৩ মার্চ পৃথক পৃথক পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনর্গঠন :
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হলেও এ সংক্রান্ত রিভিউ দরখাস্তটি অনিষ্পন্ন ছিল। গত ২০ অক্টোবর ২০২৪ আপিল বিভাগ কর্তৃক উক্ত রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হলে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয়।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে স্বীয় পদ হতে পদত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করলে গত ১৯ নভেম্বর  তাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। এছাড়া, ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতির বিষয়ে অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি তাদের বেঞ্চ প্রদান হতে বিরত থাকেন। তাদের মধ্যে একজন (বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন) গত ৩০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে নিজ স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করেন। এছাড়া, দুইজন বিচারপতি (বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম এবং মাননীয় বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন) হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাননি। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন। গত বছরের ৩০ জুলাই ২০২৪ তাদের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে আরো ছয় মাসের জন্য অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ তাদের সেই বর্ধিত মেয়াদও শেষ হয়। এছাড়া, অপর দুইজন বিচারপতি (বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান এবং বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস) ইতোমধ্যে অবসর গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান গত ৩০ ডিসেম্বর, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস গত ৩০ জানুয়ারি তাদের চাকরিকালীন মেয়াদ পূর্ণ করে অবসরে যান। এছাড়া সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর রাষ্ট্রপতি দুইজন বিচারপতিকে অপসারণ করেন। এর মধ্যে বিচারপতি খিজির হায়াতকে গত ১৮ মার্চ এবং বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানকে গত ২১ মে অপসারণ করা হয়।  গত ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি আখতারুজ্জামানের পদত্যাগ পত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে অপর চারজন বিচারপতির বিষয়ে কাউন্সিলের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

বদলি ও পদায়ন নীতিমালা :
প্রধান বিচারপতি ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত বৈষম্য দূরীকরণে নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়ন সংক্রান্ত একটি নীতিমালার খসড়া প্রস্তুতক্রমে বদলি ও পদায়ন নীতিমালাটি বাস্তবায়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট হেল্প লাইন :
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রধান বিচারপতি কর্তৃক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে আগত কোনো বিচারপ্রার্থী বা সেবাগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে বা সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হলে ওই সেবাগ্রহীতাকে সহায়তা করার নিমিত্ত একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা উক্ত হেল্পলাইন পরিচালনা করেন এবং সেবাগ্রহীতাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করে থাকেন। ওই হেল্প লাইন স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় হেল্প লাইনটি চালু করা হয়। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতি রোববার হতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা হতে বেলা ৪ টা পর্যন্ত ওই হেল্পলাইন সার্ভিস হতে সেবা গ্রহণ করা যায়। একইসাথে হেল্পলাইন নাম্বারে হোয়াটসঅয়াপ ও মোবাইল অ্যাপ সার্ভিস চালু রয়েছে।

গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট হেল্প লাইনে সারা দেশ থেকে আইনি পরামর্শ, মামলা ুসম্পর্কিত তথ্য ও অভিযোগ দাখিল-সংক্রান্ত ৩ হাজার ৭২টি কল এসেছে। এর মধ্যে আইনি পরামর্শ পেতে ১ হাজার ৬৬৮টি কল এসেছিল। বিভিন্ন মামলার তথ্য জানতে এসেছিল ১ হাজার ১৫৭টি কল।

সারাদেশের আদালতে হেল্পলাইন চালু :
গত ১৪ মে প্রধান বিচারপতি দেশের সকল নাগরিকের বিচার সেবায় অভিগম্যতা এবং বিচার সংক্রান্ত অবাদ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের সকল অধস্তন আদালত/ট্রাইব্যুনালে বিচারিক সেবা প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা ও নানাবিধ অনিয়ম দূরীকরণের উদ্দেশ্যে দেশের ৬৪ জেলায় ও ৮ টি মহানগর এলাকায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আদলে হেল্পলাইন চালুর ঘোষণা দেন। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি সার্কুলার গত ১৩ মে ইস্যু করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে হেল্পলাইন সার্ভিস ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে উক্ত সার্কুলারে প্রতি জেলায় ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। মনোনীত একজন বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা এই হেল্পলাইনের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিন সদস্যের কমিটি বিচারপ্রার্থী জনগণের অনুকূলে হেল্পলাইনের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবার মাসিক প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট জেলা জজশীপের জেলা ও দায়রা জজের মাধ্যমে প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে প্রেরণ করে থাকেন। এই হেল্পলাইন চালুকরণেত্ত সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ হতে দেশের প্রত্যেক জেলা জজশীপের জেলা ও দায়রা জজ বরাবর একটি সীমকার্ডসহ মোবাইল ফোন সরবরাহ করা হয়েছে।

দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম :
বিচার বিভাগ মূলত দেশের জনগণের সেবার জন্যেই গঠন করা হয়েছে। তাই বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা কী এবং সেই প্রত্যাশা পূরণে বিচার বিভাগের কী করণীয় বা সেই প্রত্যাশা পূরণে বিচার বিভাগের কীরূপ সক্ষমতা অর্জন করা প্রয়োজন- সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে ২০২৫ সালে প্রধান বিচারপতি দেশের সকল বিভাগীয় শহরে ইউএনডিপি’র সহায়তায় Judicial Independence and Effeciency শীর্ষক Regional Conference আয়োজন করেন। এ কনফারেন্সসমূহে বিচারক, আইনজীবী, উন্নয়ন সহযোগীসহ নানা অংশীজন অংশগ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপ এর বাস্তবায়নের বাস্তব রূপরেখা তৈরির মূল ভিত্তি হিসেবে উক্ত স্টেকহোল্ডার মিটিংসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন :
গত ৩ মার্চ ২০২৫ রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রুপসী বাংলা বলরুমে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট Upholding Environemntal Justice: The Role of Judges for a Sustainable Future শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এছাড়া, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন National High Court of Brazil এর প্রধান বিচারপতি Mr. Justice Antonio Herman Benjamin.

প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ২২ জুন রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রুপসী বাংলা বলরুমে Judicial Independence and Efficiency in Bangladesh শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রধান বিচারপতি বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

বিচারিক কূটনীতি ও বিচারব্যবস্থার আন্তর্জাতিকীকরণ :
প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক বিচার ব্যবস্থা হিসেবে উন্নীতকরণে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী যেমন, UNDP, Commonwealth Secretariat, Giz, UNICEF, OHCHR, UNHCR, JICA, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) এর সাথে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষে বিভিন্ন সভা, সেমিনার করেছেন এবং প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। বিদেশি এই সকল উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধান বিচারপতির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।

প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি তাদের নিকট হতে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। প্রধান বিচারপতি তুরস্ক, থাইল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন। সেকল দেশের বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়নের আদলে কীভাবে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা যায় সে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।  প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিলিস্তিন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, পারস্পরিক দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং উক্ত দেশের বিচারব্যবস্থার আদলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়ে প্রধান বিচারপতি কেবল দেশের মধ্যেই নয় বরং দেশের বাহিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

এভাবে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারে তার ঘোষিত রোডম্যাপের সফল বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতকরণে সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করছেন।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে- কমিশন পুনর্গঠন :
প্রধান বিচারপতি তার রোডম্যাপ ভাষণে বিচারকগণের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ লক্ষ্যে তিনি গত ৬ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি এস এম এমদাদুল হককে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন এর সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করেন। এছাড়া, প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে গত ১৩ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট হতে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের ৩০ ভাগ বিচারিক ভাতা বিদ্যমান পে-স্কেপ হতে প্রদান সংক্রান্ত একটি পত্র আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়, যা বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিচারকদের সুদমুক্ত গাড়ী নগদায়ন সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ :
প্রধান বিচারপতি সরকারের অন্যান্য কর্মবিভাগের কর্মকর্তাদের অনুরূপ বিচারকগণের সুদমুক্ত গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এ লক্ষ্যে, গত ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত ১২ ডিসেম্বর বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের অনুকুলে সুদমুক্ত গাড়ী নগদায়ন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণীত হয়।

আদালত প্রাঙ্গণসহ বিচারকগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ:
সারাদেশে অবস্থিত আদালতসমূহের প্রাঙ্গণসহ আদালতে কর্মরত বিচারকগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রধান বিচারপতি বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। গত ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট  কর্তৃক এ লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এছাড়া, আদালত ও আদালতে কর্মরত বিচারকগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নির্দেশনা প্রদান করে গত ১৫ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর হতে নির্দেশনা জারি করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কার :
গত ৭ জানুয়ারি সংস্কারকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ভবন ও এজলাস কক্ষের  উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

দেশের চৌকি আদালতসমূহে কম্পিউটার প্রদান :

প্রধান বিচারপতি ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপে বিচার সেবার আধুনিকায়নসহ দ্রুততম সময়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির বিচারসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত চৌকি আদালতসমূহে আগত বিচারপ্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত বিচার সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণসহ ওই চৌকি আদালতসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে  আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট হতে প্রয়োজনীয় ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

অধস্তন আদালতসমূহে কম্পিউটার সরবরাহ :

সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অধস্তন আদালতে ৪০০ টি ডেস্কটপ কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া, উক্ত সময়ে দেশের ১২০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ল্যাপটপ কম্পিউটার প্রদান করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার এক বছরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের ধারণাকে বাস্তবায়নের এক স্পষ্ট প্রতিফলন। এটি প্রত্যাশিত যে,  এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আগামী দিনে আরো দক্ষ, স্বচ্ছ ও জনবান্ধব বিচার ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বমানের উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।