শিরোনাম
আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ২৮ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : দেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একমাত্র গাঙ্গেয় দ্বীপের জেলা ভোলা প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ হওয়ায় এখানে দিন দিন শিল্পোদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ছে। দেশের হেভীওয়েট শিল্প মালিকগন তাদের কলকারখানা স্থাপনে নদীমাতৃক জেলা ভোলাকে বেঁছে নিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, বিদেশী অর্থায়নের চায়না কোম্পাণীগুলোও ভোলায় তাদের শিল্প কারখানা স্থাপন করতে জেলা সদরের শিবপুর ইউনিয়নে বিশালাকার জমি অধিগ্রহন করেছেন। কারন এখানকার ৯ টি কুপে বিপুল পরিমান গ্যাসের মজুত রয়েছে। আর গ্যাসকে কেন্দ্র করেই দেশ-বিদেশের নামীদামি কোম্পাণীগুলো তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ভোলায় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন।
ইতিমধ্যেই কাজী গ্রুপ জেলা সদরের খেয়াঘাট সড়কের পার্শ্বে তাদের ফিড তৈরির কারখানা স্থাপন করে তাদের উৎপাদিত পন্য দেশব্যাপী সরবরাহ করছেন। শেলটেক কোম্পানী শহরতলীর পশ্চিম ইলিশা এলাকায় বিশাল এলাকা জুড়ে আরো পাঁচবছর আগেই কারখানা স্থাপন করেছেন। সেখানে প্রতিনিয়ত হরেক রকমের মানসম্মত টাইলস তৈরী করা হচ্ছে। কোম্পানীর ডিজিএম মো. সাফকাত হোসেন জানান, তারা গ্যাস চালিত কারখানায় আন্তর্জাতিকমানের টাইলস তৈরি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করে থাকেন।
ভেদুরিয়া এলাকায় উর্মি গ্রুপ বিশাল এলাকা জুড়ে তাদের কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। একই ইউনিয়নে জমি অধিগ্রহণ করে বিশাল এলাকা নিয়ে অসংখ্য আইটেমের পন্য কারখানা তৈরির কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন প্রাণ আর এফএল কোম্পানি। তাছাড়া এখনকার বিসিক শিল্পনগরীতেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গ্যাস ভিত্তিক ইউরিয়া সার কারখানার। ইতিমধ্যে এই কারখানা স্থাপনে জমি অধিগ্রহণে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানন, ভোলার জেলা প্রশাসন।
তিন হাজার ৪০৩ দশমিক ৪৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপ জেলায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস। এখানে গ্যাস ভিত্তিক শিল্প কারখানা গড়ে উঠার সাথে সাথে যেমনি লাভবান হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন জেলার কয়েক হাজার যুবক ও নারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে গড়ে উঠা কলকারখানা গুলিতে জেলার কমপক্ষে তিন সহস্রাধিক নারী পুরষ কাজ করছেন। একসময় যেসব যুবক বেকারত্বের ঘানি মাথায় নিয়ে হতাশায় দিন কাটাতেন, মা-বাবার মাথার বোঝা ছিলেন, আজ তারা কর্মঠ কর্মজীবি সফল সন্তান। বেকারত্ব কাটিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অভাবের পরিবারে তারা এখন আলো জালিয়েছেন। হাসি ফুটিয়েছেন মা-বাবার মুখে।
গ্যাস সমৃদ্ধ ভোলাতে আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে একযুগ আগেই চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সে লক্ষ্যে তারা ভোলা শহরতলীর শিবপুর ইউনিয়নের মেঘনা তীরবর্তী এলাকাকে বেঁছে নিয়েছেন। সেখানে অধিগ্রহণ করেছেন শত একর জমি। আরো বিপুল পরিমান জমি অধিগ্রহণ করার কাজ চালাচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি চীনের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে ভোলায় একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (Free Trade Zone) স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি যেমন প্রাণ ফিরে পাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও ভোলার পণ্য পৌঁছে যাবে নতুন মাত্রায়।
চায়না ফ্রি ট্রেড জোন অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মি. প্যান লি জানান, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের সাথে মিলে ভোলা জেলায় এ ফ্রি ট্রেড জোন গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, হস্তশিল্পসহ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নানা পণ্যের রপ্তানির নতুন সুযোগ তৈরি হবে।
ভোলা আইল্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, চট্টগ্রামের সিফুড প্রসেসিং প্ল্যান্ট এবং কক্সবাজারের প্রস্তাবিত সিফুড প্রসেসিং পার্কের জায়গাও পরিদর্শন করেছেন বলে জানান। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের চাল, ফল, মাছ এবং অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য চীনা বাজারে ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এ জন্য অনলাইন ও অফলাইন উভয় মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।
চীনের ছেংতু শহরে বাংলাদেশের জাতীয় প্যাভিলিয়ন স্থাপনের কার্যক্রমও চলছে, যেখানে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও উচ্চমানের পণ্য বিশ্ববাজারে তুলে ধরা হবে বলেও প্রতিনিধি দলটি ভোলার জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
এদিকে ভোলা জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য চীনকে অনুমতি দিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। আর ‘লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ এর উন্নয়ন কাজ করবে। মূলত এখানে মৎস্য ও মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন এবং কৃষি-শিল্পভিত্তিক কারখানা স্থাপিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সভায় সম্প্রতি এ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভোলা ইকো-ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক জোন’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প খাতের অন্যতম সমস্যা গ্যাস সংকট। কিন্তু ভোলায় গ্যাসের মজুত আছে। এছাড়াও এখানে দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। বিনিয়োগ হবে ১ বিলিয়ন ডলার। এসব বিবেচনায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বেজার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) এ তথ্য জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট তথ্যানুযায়ী লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ হলো- একটি চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে এ সংস্থাটি বাংলাদেশে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে ভোলা জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়া হয়েছে। ভোলা সদর উপজেলায় ১০২ দশমিক ৪৬ একর জমিতে গড়ে উঠবে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল। পর্যায়ক্রমে যা ১৫৮ একরে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। আর এ অঞ্চলটি হবে একটি পরিবেশবান্ধব, শ্রমঘন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প এলাকা। এখানে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন এবং কৃষি-শিল্পভিত্তিক নানা কারখানা স্থাপিত হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে ৪০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে, যা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বাসসকে জানান, গ্যাস সমৃদ্ধ এ জেলায় দেশি-বিদেশি শিল্প কোম্পানিগুলো যেভাবে তাদের বিনিয়োগ শুরু করেছেন, তাতে করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভোলা হবে দক্ষিণাঞ্চলের সিঙ্গাপুর। এখানকার কোনো যুবকই আর বেকার থাকবেনা। শিল্প বিপ্লবের ফলে ভোলার দৃশ্যপট পাল্টে যাবে বলেও অভিমত ব্যাক্ত করেন, ভোলার জেলা প্রশাসনের এই শীর্ষকর্তা।