শিরোনাম
সেলিনা সুলতানা
ঢাকা, ২১ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : হাতি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সুষ্ঠুভাবে করার লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো তিনবছর মেয়াদী একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
বিগত ২০১৫ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে স্থায়ী হাতি রয়েছে ২১০-৩৩০টি এবং অস্থায়ী বা ভ্রমণকারী হাতি রয়েছে ৮০-১০০ টি। কয়েক দশক ধরে বনের অভ্যন্তরে জনবসতি বিস্তৃতির কারণে হাতির আবাসস্থল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বন্য হাতির খাদ্য ও পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এ কারণে হাতি জনবসতিতে হরহামেশাই ঢুকে পড়লে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে পড়ে।
হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ, উন্নয়ন, নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। হাতি-মানুষের সংঘাতের কারণ নিরুপণ ও সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষণা। হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহার, হাতির সংখ্যা স্থিতিশীল রাখা এবং হাতির মৃত্যু হার হ্রাস ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে প্রকল্প সাজানো হয়েছে।
পাশাপাশি হাতিকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
হাতির জন্য ২১টি জলাধার তৈরি করা হবে দেশের সব বন বিভাগে। ট্রি টাওয়ার করা হচ্ছে হাতির নিরাপদ চলাচলের জন্য। হাতির চলাচলের প্রতি নজর রাখতে হাতির গলায় স্যাটেলাইট বা জিপিএস কলার রাখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বের কারণ নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবার চিহ্নিতকরণ, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন(সমগ্র বাংলাদেশ), হাতিসহ অন্যান্য বণ্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা, হাতি-মানুষের দ্বন্ধ নিরসনে এনথ্রোপোজেনিক প্রভাব নিরুপণ-ইথনোগ্রাফিক জরিপ ও হাতিসহ অন্যান্য বণ্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা,আন্ত:দেশীয় সীমান্ত এলাকার হাতি সংরক্ষণের জন্য সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন। হাতি সংরক্ষণে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্তকরণ, হাতি হত্যার কারণ শনাক্তকরণ ও হাতি হত্যা বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, হাতির সংখ্যা জানা, হাতির স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ, হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্বের কারণ নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন (সমগ্র বাংলাদেশ), হাতিসহ অন্যান্য বণ্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণা,হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে এনথ্রোপোজেনিক প্রভাব নিরুপণ ও ইনথ্রোগ্রাফিক জরিপ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, হাতি সংরক্ষণে হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে। হাতির উপযোগী গাছ, করিডোর চিহ্নিতকরণ, সংখ্যা নির্ধারণ এবং মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়োপযোগী কাজ।
উপদেষ্টা বলেন, ‘হাতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে হাতির খাদ্যোপযোগী গাছের বাগান, ৫০ হেক্টর বাঁশবাগান সৃজন এবং রোপিত উদ্ভিদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলেও জানান তিনি।
উপদেষ্টা জানান, মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ইকোলোজিক্যাল বাউন্ডারি বায়োফেন্সিং নির্মাণ করা হবে, যেখানে বেত, লেবু ও বড়ইসহ কাঁটাজাতীয় জীবন্ত বেড়া দিয়ে ১০ কিলোমিটার সীমানা তৈরি হবে। একইসঙ্গে এলিফ্যান্ট রিজার্ভ-সংলগ্ন এলাকায় ‘অ্যান্টি ডেপ্রেডেশন স্কোয়াড (এডিএস), এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) ও এলিফ্যান্ট রেসকিউ টিম’ গঠন করে কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন- হাতির চলাচল পর্যবেক্ষণে ১৬টি ট্রি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে এবং গাজীপুর সাফারি পার্ক ও ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে দু’টি হাতি উদ্ধার কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। তিনি জানান, আহত হাতির চিকিৎসার জন্য সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও শেরপুর অঞ্চলে অস্থায়ী সেড নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে এনথ্রোপোজেনিক প্রভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণ এবং নৃ-বৈজ্ঞানিক জরিপ পরিচালনা করা হবে। চট্টগ্রামের চুনতিতে ১০ একর জায়গাজুড়ে একটি হাতি অভয়ারণ্য স্থাপন করা হবে, যেখানে পোষা হাতিদের পুনর্বাসন করা হবে।
হাতি বিশেজ্ঞরা বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব হাতির ওপর সার্ভে করা জরুরী হয়ে পড়েছে। প্রায় ১০ বছরের পুরোনো গবেষণাপত্রের আলোকে বর্তমানে বিপন্নপ্রায় হাতির অবস্থা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১১১টি হাতি মারা গেছে। হাতির জন্য স্থান নির্বাচন করে তার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ ও পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
তারা বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ।
এত দীর্ঘমেয়াদি হাতি সংরক্ষণ করা যাবে। আমাদের দেশে সমাজনীতি ও রাজনীতিতে বণ্যপ্রাণীদের নিয়ে কোন তথ্য নেই। অথচ দেশের বাইরে ইলেকশনের সময় এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ করতে চাইলে জনবসতি সরানোর কোন বিকল্প নেই। জিরো পয়েন্ট থেকে বনের ভেতর যেসব জনবসতি গড়ে উঠেছে তাদের উচ্ছেদ করে বন ফিরিয়ে আনতে হবে। হাতি ও মানুষের মধ্যে যে সংকট চলছে তাতে হাতির চলাচলের স্থান এড়িয়ে চলা, পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা, হাতিকে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা, হাতির সামনে গিয়ে সেলফি তোলা, হাতিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মেরে ফেলাসহ নানা কারণে হাতিকে তারা বিরক্ত করে। এসব বন্ধ করতে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, হাতি দিবস মূলত ১২ আগস্ট। কিন্তু আমার মনে পড়ে না ঠিক কবে বাংলাদেশে বিশ্ব হাতি দিবস পালন করা হয়েছে। যেহেতু অনেকদিন হাতি দিবস পালন করা হয়নি, তাই হাতির কোন উন্নতি আমরা করতে পারছিলাম না। বিগত বছরগুলোতে হাতির যে অবস্থা ছিল সেটা গত একবছরে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
তিনি বলেন, হাতির অভয়াশ্রম করতে চেয়েছিলাম, হাতি সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল। একে সেভাবেই দেখতে হবে। দুর্যোগকালীন সময়ে হাতিসহ বণ্যপ্রাণি নিয়ে কী করা যায় তা ভাবা দরকার। বিপন্নপ্রায় হাতিকে বাঁচাতে হবে। জনবসতি উচ্ছেদ করে তাদের বসবাসের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
ম্যাসিভ অ্যাওয়ারনেস দরকার। মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে তাদের বিষয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।