বাসস
  ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:২৭

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর: ডিজিটালে অন্তর্বর্তী সরকারের যুগান্তকারী সাফল্য

প্রতীকী ছবি।

ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫(বাসস): ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতনের এক বছরের মধ্যেই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের ডিজিটাল ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংস্কার নিয়ে এসেছে।

পতিত স্বৈরাচারী সরকারের ব্যাপকভাবে সমালোচিত ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, নজরদারি এবং সেন্সরশিপ নীতির চূড়ান্ত অবসান ঘটিয়ে অন্তর্বর্তী প্রশাসন নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের অধিকার নিশ্চিত করেছে, দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে একে আর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না।

পাশপাশি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে চালু করা হয়েছে ইলন মাস্কের লো-আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’। এই পরিষেবার মাধ্যমে শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত উচ্চগতির ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের ডিজিটাল বৈষম্য দূর করতে এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ককে ‘গেম-চেঞ্জার’ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

এই অগ্রগতি ধরে রাখতে সরকার প্রণয়ন করেছে ‘সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স, ২০২৫’ যা নাগরিকদের ডেটা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং অনলাইন স্বাধীনতা সুরক্ষায় আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক নিশ্চয়তা দেয়। এই অর্ডিন্যান্স পুরনো দমনমূলক আইনগুলো বাতিল করে দিয়েছে, যেগুলো ক্ষমতাচ্যুত সরকার ভিন্নমত ও গণমাধ্যমকে দমনে ব্যবহার করত।

বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারে এসব ডিজিটাল সংস্কার জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করেছে এবং ভবিষ্যতমুখী বাংলাদেশের ভিত গড়ে তুলেছে। বিকাশমান প্রযুক্তি, স্টার্টআপ ও ডিজিটাল শিক্ষায় গত এক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

দেশ এখন ফ্যাসিবাদ পতনের বর্ষপূর্তি এবং অধিকার ও উদ্ভাবন নির্ভর অন্তর্বর্তী নেতৃত্বের উত্থানের মূল্যায়নে মগ্ন। গত এক বছরে তথ্যপ্রযুক্তিতে অর্জিত সাফল্যকে জুলাই অভ্যুত্থান এবং জনগণের পরিবর্তনের দাবির গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে সাধারণ মানুষ। 

বাংলাদেশে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক সেবা চালু:

সরকারি তথ্যানুযায়ী, বিটিআরসি থেকে ১০ বছরের দুটি লাইসেন্স পাওয়ার পর গত ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে স্টারলিংক। প্রাথমিকভাবে তারা দুটি রেসিডেন্সিয়াল প্ল্যান দিচ্ছে, একটি ৬ হাজার টাকায় এবং অন্যটি ৪ হাজার ২শ’ টাকায়। দুই প্ল্যানেই গতি ৩শ’ এমবিপিএস পর্যন্ত, তবে দ্বিতীয়টি পিক টাইমে গতি কমে যেতে পারে। এককালীন সেটআপ খরচ পড়বে ৪৭ হাজার টাকা।

সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স, ২০২৫:

সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স, ২০২৫ অনুযায়ী, অনলাইন জালিয়াতি, হ্যাকিং, ডিজিটাল হয়রানি, ভুয়া সংবাদ, সাইবার সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন অপরাধ শনাক্ত, প্রতিরোধ ও দমনে এই আইন কার্যকর থাকবে। এই আইনের মাধ্যমে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে।

ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি: 

বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) ২০২৫ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথে ৪ টেরাবাইট প্রতি সেকেন্ড পার করে। এটি স্টারলিংক চালুর পর ২শ’ গিগাবিট ব্যান্ডউইথ যোগ করায় সম্ভব হয়েছে। এই অগ্রগতি এসেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নীতিগত সহায়তা, কোম্পানির ব্যবস্থাপনার উদ্যম এবং ব্যান্ডউইথের দু’দফা মূল্য হ্রাসের ফলে। এক বছরে ব্যান্ডউইথ বেড়েছে ১০৫ শতাংশ পর্যন্ত।

বিটিআরসি নতুন নির্দেশনায় আইআইজি অপারেটরদের অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ সাবমেরিন কেবল থেকে গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে। এতে করে ভারতের ওপর নির্ভরতা কমেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএসসিপিএলসি ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ ছাড়ে প্যাকেজও চালু করেছে।

সরকার ইতোমধ্যে এসইএ-এমই-ডব্লিউই ৪, এসইএ-এমই-ডব্লিউই ৫ ও এসইএ-এমই-ডব্লিউই ৬ সাবমেরিন কেবল সিস্টেমে সংশোধিত রুটে যুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তি করেছে, যার বাস্তবায়ন হলে বিএসসিপিএলসি’র সক্ষমতা আরো ১৭ টেরাবিট বাড়বে।

ডিজিটাল অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং বৈষম্য হ্রাস:

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এর নেটওয়ার্ক ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে যাতে ইউনিয়নের মধ্যে সমস্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, গ্রোথ সেন্টার এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সংযোগ নিশ্চিত করা যায়। এছাড়াও, ৬৫৩টি ইউনিয়নে ডিজিটাল বৈষম্য দূর করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

আইসিটি শিক্ষা ও তরুণদের সংযুক্তিকরণ:

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি ডিভিশন) মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহ বাড়াতে ২০২৫ সালের জাতীয় হাই স্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। 

সারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসমূহে প্রোগ্রামিংকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত বাংলাদেশেও প্রযুক্তিবিদ ও প্রোগ্রামারের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। যা এ ধরনের কার্যক্রমের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

এছাড়াও ‘রোবটিক্স ফর জুনিয়র’ শীর্ষক একটি আলাদা আয়োজনে স্কুল শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

তথ্যের সত্যতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা:

প্রজাতন্ত্রের সকল মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার জন্য ‘ডিজিটাল ভেরিফিকেশন ও ফ্যাক্ট-চেকিং’ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশপাশি ‘কম্প্রিহেনসিভ সিকিউরিটি ফর কেপিআই: ফিজিক্যাল অ্যান্ড সাইবার পার্সপেকটিভ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য সক্ষমতা উন্নয়ন:

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল(বিসিসি) গত বছর মোট ৫৪ হাজার ৮০৩ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৫৯ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিকেআইআইসিটি ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে। আর ২৩১ জন প্রতিবন্ধীকে কম্পিউটার ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন:

বিসিসি ডিজিটালভাবে দক্ষ জাতি গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। টায়ার-৩ জাতীয় তথ্যকেন্দ্র থেকে ২৫০টি প্রতিষ্ঠান ৮ হাজার ৫২৯টি সেবা পেয়েছে। যার মধ্যে ছিল ইমেইল, ওয়েবসাইট ও অ্যাপ্লিকেশন হোস্টিং, ভিপিএস, নেটওয়ার্ক এবং স্টোরেজ সেবা।

বিশ্বজুড়ে পরিচিতি ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম উন্নয়ন:

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে ফ্রান্স, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে আন্তর্জাতিক রোড শো করা হয়েছে।

এছাড়াও, স্টার্টআপ খাতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে তিনটি প্রধান কর্মসূচির। এগুলো হল, ইয়ুথ স্টার্টআপ সামিট ২০২৫, বাংলাদেশ স্টার্টআপ কানেক্ট ২০২৫ এবং দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এক্সপ্যান্ড নর্থ স্টার (জিটেক্স) ২০২৪।

মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামো সম্প্রসারণ:

২০২৫ সালের মধ্যে ৫৫ হাজার এবং ২০৩১ সালের মধ্যে দেড় লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে ৩৬ হাজার ৫৩৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

দেশের ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব, নাটোর ও রাজশাহীতে আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। আরো ৪৫টি কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেজন্য ৩২ জেলায় প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নের কাজ চলছে।

নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তায় চুয়েটে আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর এবং খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে।

১০৮টি হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি ট্রেনিং সেন্টার তৈরি হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ১১টি বর্তমানে চালু আছে। ৬৪ জেলায় হচ্ছে ইনকিউবেশন সেন্টার। ইতোমধ্যে ৪১ হাজারেও বেশি মানুষ প্রশিক্ষণ পেয়েছে। 

এদিকে ২৩০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে প্লট ও স্পেস দেওয়া হয়েছে এবং ১৫১টি স্থানীয় স্টার্টআপকে ফ্রি কো-ওয়ার্কিং স্পেস দেওয়া হয়েছে। এসব পার্কে ২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ৫৩ হাজার ৬৫৪টি সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আইডিইএ প্রকল্পের আওতায় ৪৭২ জন নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ২.৩৬ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবস্থাপনা ও অ্যাপ তৈরি হয়েছে এবং রিকশা নিবন্ধনের জন্য আলাদা মডিউল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।

দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমকে উদ্বুদ্ধকরণ ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ:

দায়িত্বশীল কনটেন্ট তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে দেশের ১৮টি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনকে। এছাড়াও ডিজিটাল ও মিডিয়া সাক্ষরতা, ১৬ দিনের সামাজিক সংহতির কর্মসূচি, বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রচার, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং দায়িত্বশীল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ (টিওটি) এবং বাংলাসহ ৪১টি ভাষার বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে, যাতে সেগুলো বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়।

ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্মরণ ও শান্তি প্রচার:

জুলাই অভ্যুত্থান স্মরণে পাঁচটি বিভাগে ‘অ্যাক্টিভিজম ফর পিস’ শীর্ষক কর্মশালা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।  সেখানে আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেওয়া তরুণরা তাদের ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করেছেন।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, যশোর ও রংপুরে ১৩৫টি শিল্পকর্মের মোট ছয়টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। দেড়শ’ তরুণ শিল্পী এতে অংশ নেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের ডিজিটাল খাতে এই উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দেশের প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যথাযথ নীতি ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল সক্ষমতা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।