বাসস
  ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৭:০৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সন্তান হারানোর বেদনায় বিমূঢ় আশিকুরের মা

ছবি: বাসস

রোস্তম আলী মন্ডল

দিনাজপুর, ২৭ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিচারণ করে আবারো যেন শোকের বন্যা বয়ে গেল শহীদ আশিকুরের বাড়িতে।  সন্তান হারানোর বেদনায় বিমূঢ় আশিকুরের মা দ্রুত সন্তান হত্যার বিচার চান।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মরণে আশিকুরের মা আরিশা আফরোজ বাসসকে বলেন, ‘দর্জির কাজ করে অনেক কষ্ট করে বুকের ধন একমাত্র ছেলেকে বড় করেছি। সেই ছেলেকে হত্যার একটি বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু খুনিদের বিচার হলো না। এখনো তদন্ত শেষ হয়নি, বিচার কবে পাবো আল্লাহ জানেন।’  

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্নেহের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই রাজধানী ঢাকার বনশ্রীতে আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হন ১৪ বছর বয়সী আশিকুর ইসলাম।  

ছেলেহারা আরিশা আফরোজ বলেন, আমার নাবালক ছেলেকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার ছেলের অপরাধ সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। 

তিনি বলেন, আমি একজন অসহায় মা। এক বছর বয়সী শিশু ছেলেকে কোলে নিয়ে স্বামীর সংসার ত্যাগ করি। দর্জির কাজ করে সন্তানকে বড় করেছিলাম। সেই ছেলেকে হারালাম।

আরিশা আফরোজ জানান, ১৩ বছর আগে নিজের চেষ্টায় ঢাকা শহরে এসেছি। রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করেছি। আশিকুরের বয়স যখন ৫ বছর,তখন তাকে রামপুরা এলাকায় একটি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেই। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়ে গত বছর ৫ আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। কিন্তু আশিকুর আমাদের সঙ্গেই থাকতো।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন গত ১৮ জুলাই দুপুরে আশিকুরসহ স্বামীকে নিয়ে ভাড়া বাসার মহল্লার একটি বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাই। খাওয়া শেষে আমি দোকানে ফিরে আসি। আশিক বাসায় যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে চলে যায়। সন্ধ্যায় খবর পাই আশিকুর আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। 

প্রতক্ষ্যদর্শীদের কাছ থেকে জানতে পারি, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে আমার ছেলে বিদ্ধ হয়। দৌড়ে চলে যাই ঘটনাস্থল বনশ্রী জি-ব্লকে।  সেখানে জানতে পারি বনশ্রী অ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে গেছে আহতদের স্থানীয়রা। সেখানে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর আশিকুরের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ দেখতে পাই।

১৯ জুলাই আশিকুরের লাশ গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার নরহরিপুর গ্রামে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

তিনি জানান, আজ দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সন্তান হত্যা মামলা ও বিচার নিয়ে কথা করবেন।

শহীদ আশিকুরের হত্যা মামলার বিষয়ে আরিশা আফরোজ বলেন, আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগে গত ২৮ আগস্ট ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে মামলা করি। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, এছাড়া ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে। কয়েক আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

তিনি বলেন, এর আগে গত ৮ মে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে তার নামে হওয়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের কাগজপত্র হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া তাকে ফ্রি চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড ও জুলাই আন্দোলনে শহীদ মাতার স্বীকৃতি সনদ প্রদান করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শহীদ আশিকুর ইসলামের বাবা ফরিদুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ায় পরিবারের সবাই মর্মাহত। এখন অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে একটাই দাবি ছেলে হত্যার বিচার চাই। 

দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৮ জন শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে একজন আশিকুর ইসলাম। শহীদ পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথমে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এরপর সরকারি সিদ্ধান্তে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র খুলে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, গত ১৪ মার্চ শহীদ আশিকুর ইসলামের হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর সিআইডি পুলিশের একজন পরিদর্শক বিচারকের আদেশে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সহাতায় কবর থেকে তার লাশ উত্তোলন করেন। 

লাশ দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করে, পুনরায় লাশ দাফন করা হয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন হলেই, আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে সিআইডি পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করবেন।