বাসস
  ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৩:২০

নেত্রকোণায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে চান অদম্য তাহমিদা

নেত্রকোণা জেলা সদরের ইসলামপুর এলাকায় ‘স্বপ্নবুনন সেলাই শিখন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে উদ্যোক্তা তাহমিদা ইসলাম এ পর্যন্ত এক হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ছবি : বাসস

।। তানভীর হায়াত খান।।

নেত্রকোণা, ১৩ জুলাই ২০২৫ (বাসস): জেলা সদরের ইসলামপুর এলাকার ‘স্বপ্নবুনন সেলাই শিখন কেন্দ্র’ আজ হয়ে উঠেছে শত শত নারীর নির্ভরতার আশ্রয়। এর পেছনে আছেন এক অদম্য নারী। নীরব সংগ্রামী তাহমিদা ইসলাম। বর্তমানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অস্থায়ী প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত তাহমিদা এ পর্যায়ে আসতে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ বন্ধুর পথ। 

নেত্রকোণা সদর থানার তেতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কুদ্দুস ও সেলিনা খানম দম্পতির কন্যা তাহমিদা ইসলাম (৩৭)। স্নাতক পাশ করেছেন। ঘরে বসে না থেকে নিজে কিছু করার তাগিদেই  ২০০৪ সালে প্রথম যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহায়তায় সেলাই প্রশিক্ষণ  নেন। প্রথমে নিজে নিজেই কাজ শুরু করেন। ২০০৫ সাল থেকে তিনি নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। 

২০০৫ সালে সমাজের চোখে গুরুত্বহীন সুই-সুতো নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তাহমিদা ইসলাম। মাত্র তিনজন নারী নিয়ে শুরু হওয়া সেই ছোট উদ্যোগটির পেছনে ছিল এক গভীর বিশ্বাস- ‘নারী শুধু কারো উপর নির্ভর করে বাঁচার জন্য নয়, তারা নিজেরাই হতে পারে নিজের জীবনের নির্মাতাও’। এই মূল মন্ত্রই তাকে আজ সাফল্য এনে দিয়েছে।

তাহমিদা জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ নারীকে স্বপ্নবুনন থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, হতদরিদ্র নারীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেওয়া হয় এই প্রতিষ্ঠানে। 

এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকার অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী।  তাদের কেউ খুলেছেন টেইলারিং শপ, কেউ ঘরে বসেই নিচ্ছেন পোশাক তৈরির অর্ডার, আবার কেউবা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছেন দেশের বাইরেও। এই নারীদের অনেকেই এখন পরিবারের মূল উপার্জনকারী। তাদের জীবনে ‘স্বপ্নবুনন’ শুধু একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নয়, নতুন জীবনের দরজা।

তাহমিদা ইসলাম শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পা রেখেছেন নেত্রকোণার প্রত্যন্ত গ্রামেও। অসহায়, বিধবা, অধিকার বঞ্চিত ও দরিদ্র গৃহবধূদের কাছে। নিজে হাতে ধরে তাদের শিখিয়েছেন ব্লাউজ, পেটিকোট, থ্রিপিস কিংবা শিশুদের পোশাক তৈরির কৌশল। শিখিয়েছেন পোশাক বিক্রি ও বাজারজাত করার কৌশল। 

স্বপ্নবুননে যারা কাজ করেন তাদের নির্দিষ্ট কোন বেতন নেই। যিনি যত বেশি কাজ করবেন তিনি সে অনুযায়ী মজুরি পাবেন। অনেকে এখানে দৈনিক এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। প্রতিদিন ‘স্বপ্নবুনন’-এ আসেন ৫০-৬০ জন নারী। কারও হাতে স্কুলব্যাগ, কারও চোখে সংসারের ক্লান্তি, আবার কারও মনে নতুন জীবনের আশা। 

স্বপ্নবুননের কর্ণধার তাহমিদা ইসলাম বলেন, ‘স্বপ্নবুনন সেলাই শিখন কেন্দ্র’ কেবল কাপড় সেলাই শেখায় না, গড়ে তোলে আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা আর আত্মসম্মানবোধ।’

স্বপ্নবুননে কর্মরত কলমাকান্দা উপজেলার রুকসানা বেগম জানান, গ্রামের  বাড়িতে  টুকটাক কাজ করতেন। 

বেশি আয় হতো না। তাই বেশি আয়ের জন্যে সরাসরি স্বপ্নবুননে কাজ করছেন। এখানে এসে আয় বেড়েছে।  

মেয়ে এবং অসুস্থ স্বামীর ভরনপোষণের খরচ জোটাতে পারছেন তিনি।

দশ বছর ধরে কাজ করছেন জেসমিন আক্তার। বাড়ি মোহনগঞ্জ উপজেলায়। স্বপ্নবুননের মোহনগঞ্জ শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং পরিবারকে সহযোগিতা করছেন। এই শাখায় সেলাইয়ের পাশাপাশি বেত, বাঁশের  বিভিন্ন পণ্য, হরেক রকমের আচার ও পিঠা তৈরি করে বিক্রি করা হয়। 

নিজের উদ্যোগের পাশাপাশি বর্তমানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অস্থায়ী প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। 

এই মর্যাদা তাকে যেন আরও উৎসাহ জোগায়। প্রত্যয়ী করে তোলে। প্রশিক্ষণার্থীদের ও দেখায় পথের দিশা। 

উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা গাজী মোবারক হোসেন বাসসকে বলেন, ‘নেত্রকোণায় যারা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আছেন  তাহমিদা তাদের মাঝে অন্যতম। অনেক প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে প্রান্তিক পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন। তার সাথে এখন যারা কাজ করছেন তারাও প্রান্তিক পর্যায়ের। তাহমিদার মাধ্যমে এই অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।  

তিনি বলেন, ‘সাফল্য লাভের পর অনেকেই নিজের অতীত ভুলে যায়। কিন্তু তাহমিদা ব্যতিক্রম। তিনি পরিশ্রমী। নিজেই প্রশিক্ষণার্থীদের শেখান। আশা করি তিনি সামনে আরো ভালো কিছু করবেন। রাষ্ট্রীয় সুযোগ, সুবিধা,পৃষ্ঠপোষকতা পেলে  তিনি বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ পাবেন।’ 

তাহমিদার প্রতিবেশী স্থানীয় এনজিও কর্মী মালা রাণী পাল বলেন, ‘ তাহমিদা শুরু থেকেই সংগ্রাম করে আসছেন।  নিজেই শুধু স্বাবলম্বী হন নি, অন্য নারীদেরও কাজ করার প্রশিক্ষণ, সুযোগ, সুবিধা করে দিচ্ছেন। 

এখান থেকে কাজ শিখে গিয়ে অনেকেই এখন বাইরে কাজ করছেন এবং স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও ধৈর্য দেখে অবাক হই।  বড় পরিসরে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি আরো ভালো করবেন বলে বিশ্বাস করি।’

তাহমিদা বলেন, ‘আমি চাই জেলার অন্য উপজেলাতেও স্বপ্নবুননের মতো আরও শত শত কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ুক। ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু একটু সহযোগিতা, নীতিনির্ধারকদের নজর এবং মানুষের আন্তরিক স্বীকৃতি।’

তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছে নেত্রকোণায় দুটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করার। যার একটি থাকবে জেলা শহরে এবং অপরটি মোহনগঞ্জে। এজন্য জেলা শহরে একটি উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

তাহমিদা বলেন, আমার জীবনে কোনো নাটকীয়তা নেই। আমি সেইসব  নারীদের একজন, যাদের দিন কাটে রান্নাঘর, সন্তান আর সংসার নিয়ে-নীরব, নিঃশব্দ ও প্রায় অদৃশ্যভাবে। চার দেওয়ালের ভেতরে একঘেয়েমি আর নির্জনতায় কাটতো সময়। কিন্তু এক সময় মনে হলো, এই জীবন কি শুধুই বয়ে যাওয়া? তাই সময়কে কাজে লাগানোই ছিল আমার সিদ্ধান্ত। 

তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, একজন নারীর ক্ষমতায়ন মানে কেবল তার নিজস্ব উন্নয়ন নয়, বরং তার পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়ন। তাই নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের নারীদেরও উদ্যোগী করতে চেষ্টা করছি। কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও মানসিক সাহচর্যের মাধ্যমে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করছি।’

তাহমিদার স্বামী তরিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, একজন স্বামী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে আমি আজ গর্বিত। কারণ আমার স্ত্রী তাহমিদা শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের অনেক নারীর জন্য আলোর দিশা হয়ে উঠেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের সমাজে এখনো অনেক সময় নারীর স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, একজন নারীর সাফল্য মানে পুরো পরিবারের, এমনকি পুরো সমাজের অগ্রগতি। তাহমিদা যখন তার নতুন উদ্যোগের কথা জানায়, আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম , তার পাশে থাকব, তাকে সাহস দেব। আজ আমি বলতে পারি, তাহমিদার সাহস, পরিশ্রম ও আত্মনির্ভরশীলতা কেবল আমাদের পরিবারকেই শক্তিশালী করেনি, বরং আশপাশের অনেক নারীর জীবনেও নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

তরিকুল সকল পুরুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনার পরিবারের নারী যদি কিছু করতে চায়, তাকে থামিয়ে দেবেন না। তার পাশে দাঁড়ান, তাকে পাথেয় দিন। কারণ একজন নারীর অগ্রযাত্রা কেবল তার একার নয়, সেটা সন্তান, পরিবার ও সমাজের উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি।’

তাহমিদার ননদ তাসমিয়া তহুরা বাসসকে বলেন, ‘তাহমিদা আমার ভাবী তার পরিচয় এতটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। শৈশব থেকেই দেখেছি তার মমতা, নিষ্ঠা আর নীরব শক্তিকে। আজ তিনি শুধুই একজন নারী নন, একজন পথপ্রদর্শক। যিনি নিজে আলোর পথ খুঁজে নিয়েছেন এবং অন্যদের পথ দেখাচ্ছেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার কাছে একেকটি জীবন্ত কবিতা-শব্দহীন হলেও গভীর অর্থবহ। তিনি আমাদের পরিবারের অহংকার, সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা।’