বাসস
  ১১ জুন ২০২৫, ১৬:৩৭

বাগেরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালে জনবল সংকট, নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম

বাগেরহাট জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল। ছবি: বাসস

।। আজাদ রুহুল আমিন ।।

বাগেরহাট, ১১ জুন, ২০২৫ (বাসস) : জেলার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে জনবল সংকটে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার রোগী। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে অসহায় দুস্থ রোগীকে যেতে হয় খুলনা বা ঢাকায়। ফলে চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হন জেলার বাসিন্দারা। 

বাগেরহাট জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হাসপাতালটি যতদিন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ছিল, সে সময়েও ছিল চিকিৎসক সংকট। এখন ২৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধানে নেয়া হয়নি কোনো কার্যকর উদ্যোগ। 

হাসপাতালের জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিনিয়র কনসালটেন্ট পদে ৮ জনের পরিবর্তে রয়েছে ২ জন। সিনিয়র কনসালটেন্ট অর্থপেডিকস ১ জন এবং কনসালটেন্ট গাইনি ১ জন। জুনিয়র কনসালট্যান্টের ১৩ জনের পরিবর্তে রয়েছে ৪ জন। মেডিক্যাল অফিসারের ৩০ টি পদে আছেন ১৫ জন। নার্সের ১২৫ পদের বিপরীতে আছেন ৭০ জন। তৃতীয় শ্রেণির ৩০ জনের স্থলে আছেন ১৫ জন। নিরাপত্তা প্রহরী ৮ জনসহ ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার, কুক, মশালচি,  ইলেক্ট্রিশিয়ান, পাম্প  অপারেটরসহ ৬৬ জন আছেন আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের বেশিরভাগই দলীয় প্রভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত  এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে।  

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়,  এ বছর জানুয়ারি থেকে হাসপাতালের আইসিইউ বন্ধ রয়েছে। সিটিস্ক্যান ও এম আর আই মেশিন না থাকায় প্রথমেই রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে যেতে হয় খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এছাড়া একজন আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার, একজন আবাসিক সার্জন ও তত্ত্বাবধায়ক সব ধরনের  রোগী দেখেন ও অস্ত্রোপচার করেন। 

লোকবল ও সুযোগ সুবিধার অভাবে মুমূর্ষু রোগীর দায়ভার নিতে চায় না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে একটু জটিল মনে হলেই রোগীকে খুলনা সদর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। 

সরেজমিনে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় সেবা নিতে আসা রোগীদের সাথে। শহরতলীর চরগা গ্রামের শিরিন, বেমরতা গ্রামের রুনু বেগম, রামপাল ঝনঝনিয়া গ্রামের আফরোজা বেগম, মোরেলগঞ্জ সোনাখালি গ্রামের কাজল, কচুয়ার বগা গ্রামের ইব্রাহীম, ভাষা গ্রামের হায়দার চিকিৎসা নিতে এসে যথোপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা জানান, জেলায় এতো বড় হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও তাদের খুলনা কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। অনেক সময় চিকিৎসার খরচ যোগাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়। 

স্থানীয় রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ২০১৪ সালে বাগেরহাট সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে গণপূর্ত বিভাগ ২০১৪ সালে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে। ২০১৮ সালে ভবনটি হ্যান্ডওভার করা হলেও জনবল সংকট নিরসন না করেই ২০২২ সালে নতুন ভবন চালু করা হয়। ফলে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসা সুবিধা বাড়েনি। বাড়েনি জনবল। ফলে রোগীদের ভোগান্তিও কমেনি।   

অন্যদিক যারা কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্বে আছেন তাদের অধিকাংশের পরিবার ঢাকায় থাকায় তারা প্রায়ই হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকেন। কেউ কেউ  ১৫ দিন থেকে ১ মাস করে ছুটি কাটান। তাদের অনেকে আবার প্রাইভেট চেম্বার করেন। এদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালাল চক্র রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করে।  

স্থানীয়দের অভিযোগ, অসুস্থতা ও অনিশ্চয়তায় দিশেহারা রোগীরা বাধ্য হয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে চিকিৎসা নিতে যান। চিকিৎসকদের পরামর্শে বেসরকারি  ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অতিরিক্ত খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় রোগী ও রোগীর পরিবার। অন্যদিকে  এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা মোটা অঙ্কের টাকা পান । 

হাসপাতালের  চক্ষু বিভাগ, মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগেও নেই কোন চিকিৎসক। বহির্বিভাগে প্রতিদিন জেলার ৯ উপজেলা ও ৩ পৌরসভা থেকে এক থেকে দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে প্রতিদিন এক থেকে দেড়শো রোগী । স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স এতো রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খান।

হাসপাতালে চিকিৎসক ও সেবার ঘাটতি থাকলেও অসহায় ও দরিদ্র রোগিদের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতাল। হাসপাতালে ২৫০ টি শয্যা থাকলেও বেশিরভাগ সময় রোগী ভর্তি থাকে সাড়ে ৩ শ থেকে ৪ শ। ফলে হাসপাতালের বারান্দায়ও  রোগীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। ডায়েরিয়া, আমাশা, করোনা, ডেঙ্গুর মতো সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ড্রেন অপরিষ্কার থাকায় দিনের বেলায়ও মশা-মাছির উপদ্রব। হাসপাতালের আশেপাশে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। এতে হাসপাতালে আসা এবং ভর্তি রোগীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। হাসপাতালের ওয়াশরুম ও টয়লেট থেকেও বেরুচ্ছে দুর্গন্ধ। সব মিলিয়ে মানবেতর পরিবেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। 

বাগেরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার অসীম সমাদ্দার বাসসকে জানান, বারবার উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ে জনবলের বিষয়টি লিখিতভাবে জানালেও কোনোই সমাধান মিলছেনা। উপরন্তু আমরা যারা দায়িত্ব পালন করি, তারাই রোগীর রোষানলে পড়ি। আমাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। এমন বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, চাকরির শেষ সময়ে হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনবল পেলে অসহায় দুস্থ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ভাবে কাজ করতাম। তাতে জীবনটা সার্থক মনে হতো। 

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডাক্তার মাহাবুবুল আলম বাসসকে জানান, হাসপাতালের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল জনবলের বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। হাসপাতালের শূন্য পদ পূরণসহ নতুন পদ সৃজন করার আবেদন জানিয়ে চিঠি স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি  দেয়া হয়েছে। 

তিনি বলেন, রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হাসপাতালের জনবল বাড়ানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে সরকার। আশা করি অবিলম্বে হাসপাতালের চিকিৎসক সংকট কেটে যাবে।

বাগেরহাটের কৃতি সন্তান সিনিয়র সচিব ডক্টর ফরিদুল ইসলাম বাবলু বাসসকে বলেন, ‘খুব শীঘ্রই এর সমাধান মিলবে।’

তিনি জানান, ইতোমধ্যে তিনি স্বাস্থ্য সচিব ও মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাথে দেখা করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাগেরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সংকটের বিষয়টি অবগত করেছেন। বাগেরহাটবাসীর কল্যাণে শিগগিরই হাসপাতালের চিকিৎসা উপকরণ, লোকবল ও চিকিৎসক সংকটের সমাধান হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।