বাসস
  ২৯ মে ২০২৫, ১৯:০৩

পশুকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যস্ত কেরানীগঞ্জের খামারিরা

কোরবানী ঈদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন কেরানীগঞ্জের খামারিরা। ছবি: বাসস

মো. জিয়াউর রহমান

কেরানীগঞ্জ, ২৯ মে ২০২৫ (বাসস) : কোরবানির পশু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের খামারি ও কৃষকরা। ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক থেকে বড় খামারিদের সবাই কোরবানিতে বাড়তি লাভের আশায় নিজেদের পশুগুলোকে হাটে তোলার জন্য প্রস্তত করছেন। বিগত দিনের লাভ-লোকসানের হিসাব মিলিয়ে মুনাফা ঘরে তুলতে আশাবাদী তারা। সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু না আসলে গরুর ন্যায্য মূল্য পাবেন বলেই তাদের বিশ্বাস। 

কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কেরানীগঞ্জে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৬ শত পশুর খামার রয়েছে। এসব খামারে ৫ হাজার ৮ শত ৪৭ টি ষাঁড়, ২শ ৩৫ টি বলদ, ৩শ  গাভি ও ২শ টি মহিষ রয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ৫৯ টি বিভিন্ন জাতের ছাগল ও ১ শ ১১টি ভেড়া রয়েছে। উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এখানকার গরু খামারের মধ্যে নজরুল ইসলাম অ্যাগ্রো ফার্ম, মালেক শিকদার অ্যাগ্রো ফার্ম, আনোয়ার অ্যাগ্রোভেট, শরীফ অ্যাগ্রোভেট, আলম ডেইরী ফার্ম, সামায়রা অ্যাগ্রোভেট, শাহজালাল ডেইরি ফার্ম, আনোয়ার হোসেন, আলী আহম্মেদ ডেইরির নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও উপজেলার তেঘরিয়া, কোন্ডা, জিনজিরা, শুভাঢ্যা, রাজেন্দ্রপুর, আব্দুল্লাহপুর, দঁড়িগাও, খোলামোড়া, নরুন্ডী, শাক্তা, আটি, কলাতিয়া, তারানগর ও হযরতপুর ইউনিয়নের অনেকেই কোরবানির পশু পালন করে নিজেরা কোরবানি দেয়ার পাশাপাশি ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিক্রি করেন। এসব পশু পালনকারী কৃষকদের গোয়ালে দেশীয় গরুর পাশাপাশি  ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের গরু রয়েছে। 
পশু পালকদের মধ্যে পেশাদার গরু ছাগল ব্যবসায়ীরা কোরবানির ৭-৮ মাস আগেই পছন্দের পশু ক্রয় করে যত্নের সাথে লালন পালন করে থাকেন। স্থানীয় এসব পশু পালকদের বেশির ভাগ কোরবানির পশুই নিজ নিজ গোয়াল থেকেই বিক্রি হয়। এছাড়া কেরানীগঞ্জের অভ্যন্তরীণ ১১ টি পশুর হাট এবং রাজধানীর নয়াবাজার, শ্যামপুর ও পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসহ বিভিন্ন হাটে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে স্থানীয় অনেকেই আগেভাগে তাদের পছন্দসই গরু কেনার পর কোরবানির আগ পর্যন্ত ওই গোয়ালেই রেখে দেয়। এজন্য তারা অবশ্য পশুর খাবার খরচ ও রাখালের জন্যও কিছু খরচ বহন করে থাকে। যারা সাধারণত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পশু পালন করে তাদের প্রত্যেকেই ৪০ থেকে ৫০টি গরু পালন করে। এর বাইরেও তাদের অনেকেরই রয়েছে সারা বছরজুড়ে ডেইরি ফার্মের ব্যবসা। তাছাড়া কোরবানির পশু পালন একদিকে যেমন পরিশ্রমের কাজ অপরদিকে এ ব্যবসা অনেক ব্যয়বহুল বলেও জানান স্থানীয় পশুপালকরা। 

ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রাণী সম্পদ বিভাগের পরামর্শে কৃমিনাশকসহ নির্দিষ্ট রোগের ওষুধ খাওয়ান। তবে ক্ষতিকর ইঞ্জেকশন ও ট্যাবলেট পরিহার করে সবুজ ঘাস ও খড়ের পাশাপাশি খৈল, গুড়া, ভুসি খাইয়ে পশুগুলোকে মোটাতাজা  করে থাকে। কোনও ভ্যাকসিন ছাড়াই প্রস্তুত করা হয়েছে দেশী, নেপালি, হারিয়ানা, অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিজিয়ামসহ নানা জাতের গরু। ফলে খামারি ও কৃষকদের এসব গরুতে কোনও ধরনের রোগ বালাইয়ের ঝুঁকিও নেই। এ কারণে বাজারে এই অঞ্চলের গরুর চাহিদাও অনেক বেশি বলে তারা জানান।
বিভিন্ন খামার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি খামারে নির্ধারিত লোক নিয়মিত গরু-ছাগলগুলোকে খাবার দেওয়া ও গোসল করানোসহ বিভিন্ন পরিচর্যা করছেন। ভালো দাম পেতে পরম যত্নে পশুগুলোর দেখভাল করছেন খামারি ও কৃষকরা। পশুর খাদ্য তালিকাটাও বেশ সমৃদ্ধ। 

ইকুরিয়ার গরুর খামারি রফিক মিয়া বলেন, এ বছর আমার ফার্মে  শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গরু ও মহিষ আছে। আমাদের পালিত পশুকে খৈল, ভুসি, কুড়া, কচুরিপানা ও প্রাকৃতিক ঘাস খাওয়াই। এর বাইরে কোনো রকম ভেজালের আশ্রয় নেই না। আমার উদ্দেশ্য কেবল ব্যবসায়িক নয়। ক্রেতারা  যাতে ভালো মানের পশু কোরবানির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত নির্ভেজাল গোশত খেতে পারে সেদিকেও আমরা খেয়াল রাখি। 

তিনি আরো বলেন, ইঞ্জেকশন, ট্যাবলেট কিংবা বৈজ্ঞানিকভাবে আবিষ্কৃত সব খাবারের মাধ্যমে পশু খুব তাড়াতাড়ি মোটাতাজা হলেও এতে পশুর জীবনের জন্যও যেমন ঝুঁকি তেমনি এসব পশুর মাংস খাওয়া আমাদের জীবনের জন্যও ঝুঁকির। 

খামারি আহাম্মেদ মিয়া বলেন, কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য দীর্ঘ ছয় মাস ধরে ৪০টি গরু নিয়ে খামার গড়ে তুলেছি। ২২ লাখ পাঁচশ টাকা দিয়ে এসব গরু কিনেছিলাম। সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে গরুগুলোকে লালন পালন করেছি। গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয়ের পরিমাণও বেড়েছে। কোরবানির হাটে গরুগুলো বিক্রি করে লাভবান হতে পারবো বলে আশা করছি।

কসামায়রা অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক ফরহাদ মিয়া বলেন, গরু মোটাতাজা করতে কোনো প্রক্রিয়াজাত খাবার ব্যবহার করি না। স্বাভাবিক যে খাবার সেটা ব্যবহার করি। খড়, ভুট্টার গুঁড়া, সয়াবিনের খৈল, ডাল, ভুসি, নারকেলের খৈল ইত্যাদি প্রধান খাদ্য হিসেবে গরুকে খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া দেশি কাঁচা ঘাসও খাওয়ানো হয়। তিনি বলেন, এবার আমাদের খামারে ৬০টি গরু আছে। ভারতীয় গরু না এলে কোরবানির ঈদ বাজারে ভালো দাম পাব। 

রোহিতপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর এলাকার ভাই ভাই অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক ওহিদুর রহমান। বিদেশ ফেরত ওহিদুর এ বছর প্রথমবারের মতো ২০টি গরু নিয়ে খামার চালু করেছেন। ঈদকে টার্গেট করে প্রথম থেকে তিনি ২০টি গরুকে দেশীয় পদ্ধতিতে পালন করে আসছেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে আমি খামারটি গড়ে তুলেছি। 

পোড়াহাটি ফিট অ্যান্ড ফ্রেশ অ্যাগ্রো খামারের মালিক আকবর আলম উৎপল বলেন, আমি প্রত্যেক ঈদে গরু বিক্রি করি। এবারও ৮ থেকে ১০টি গরু বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছি। ঘাস ও খড়ের পাশাপাশি খৈল, গুড়া, ভুসি খাইয়ে গরুগুলোকে বড় করেছি। কোনও ইনজেকশন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করি না। এজন্য প্রতিবারই আমার গরু বিক্রি হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, গো খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় গরু মোটাতাজাকরণে অতিরিক্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। খরচ বেশি হলেও লাভের আশায় বিনিয়োগ করেছি। ন্যায্য দাম পেলে লাভবান হবো। 
রোহিতপুর এলাকার কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, পুঁজি কম তাই বাড়িতে তিনটি গরু লালন পালন করেছি। দাম কেমন পাবো জানি না। কোরবানির হাটে ভারতীয় গরু আসলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ন্যায্য দাম না পেলে পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে যাবে। 

হযরতপুরের আরেক প্রান্তিক খামারি আবুল হোসেন বলেন, খামার করার সামর্থ্য নাই। বাড়িতেই দুটি গরু পালন করছি। কোরবানির হাটে বিক্রি করবো। বাড়িতে বিভিন্ন এলাকা থেকে গরু ব্যবসায়ীরা এসে গরুর দরদাম করছেন। আমার দুটি গরু ৬০ হাজার টাকায় কেনা আছে। ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করার আশা করছি।

কেরানীগঞ্জের একটি খামারে গরু কিনতে আসা রাজধানীর হাজারীবাগের বাসিন্দা খোকন আহমেদ বাসসকে বলেন, এ এলাকার খামারের গরুগুলো দেশীয় পদ্ধতিতে পালন করে হৃষ্টপুষ্ট করা হয়। যার কারণে মাংসে কোনো ক্ষতিকর উপাদান থাকে না। এছাড়া খামার থেকে সরাসরি কোরবানির গরু কেনাটা নিরাপদ। প্রতিবছর তিনি কেরানীগঞ্জের কোনো না কোনো খামার থেকে কোরবানির গরু কেনেন বলে জানান।

কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুস সাত্তার বেগ বলেন, বাজারে অসুস্থ বা কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা অসুস্থ পশুর দিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে। তবে কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করার ওষুধ সেবনে গরুর যে কোনো সময় প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে খামারিদের সতর্ক করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, ভারত থেকে গরু না আসলে এ বছর কেরানীগঞ্জের খামারিসহ প্রান্তিক কৃষকরা বেশ লাভবান হবেন।