শিরোনাম
রোস্তম আলী মণ্ডল
দিনাজপুর, ২৪ মে ২০২৫(বাসস): জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বাড়ির আঙিনায় ট্যাংকির মধ্য দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মৎস্য চাষিরা।
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) অধ্যাপক ড. মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, পার্বতীপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে বাড়ির আঙিনায় ট্যাংকি স্থাপন করে দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ করে অনেক মৎস্য চাষি সফল হয়েছেন। তারা এক বছর ধরে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ চাষ করে সফল হন।
তিনি জানান, এসব মৎস্য চাষিদের আগ্রহ দেখে হাবিপ্রবির মৎস্য অনুষদ বিভাগ থেকে তাদের আধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলক মাছ চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরামর্শ অনুযায়ী তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় ট্যাংকি স্থাপন করে দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়।
অধ্যাপক মমিনুল বলেন, প্রথম পর্যায়ে এই পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনে চাষিরা সফল হয়েছেন। জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় কয়েকটি ইউনিয়নে ৯৬ টি ট্যাংকিতে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ২০ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি ট্যাংকির উচ্চতা প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ ফুট। সম্পূর্ণ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এ পদ্ধতির নাম ‘খরাপ্রবণ এলাকায় ট্যাংকিতে উচ্চ-মূল্যের দেশি প্রজাতির মাছ চাষ’।
ট্যাংকিতে উচ্চমূল্যের দেশি মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন পার্বতীপুর উপজেলার পল্লি এলাকার অনেক মানুষ। অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় এটি অনেক বেশি লাভজনক।
সরেজমিনে দেখা যায়, পার্বতীপুর উপজেলার চণ্ডিপুর ইউনিয়নের পশ্চিম ম্যাড়েয়া গ্রামের জিয়াউর রহমান জিয়া (৩০) বাড়ির আঙিনায় ট্যাংকিতে উচ্চমূল্যের দেশি প্রজাতির মাছ চাষ করছেন। তার এসব ট্যাংকিতে কই, তেলাপিয়া, শিং ও মাগুর মাছ চাষ করা হচ্ছে।
শুধু জিয়াউর নয়, একই পদ্ধতিতে মোমিনপুর ইউনিয়নের হযরতপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম (৪২), পলাশবাড়ী ইউনিয়নের কালাইঘাটি গ্রামের সোহাগ আলী (৩৫)সহ অনেকেই এখন ট্যাংকিতে উচ্চমূল্যের দেশি প্রজাতির মাছ চাষ করছেন। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে প্রচুর পরিমাণ লাভ হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে বছরে দুই থেকে তিন বার মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। যার ফলে অল্পসময়ে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
নারী উদ্যোক্তা মাছ চাষি খাদিজা বেগম বলেন, গ্রামে কারও বাড়িতে মেহমান বেড়াতে এলে আমাদের কাছে মাছ কিনতে আসেন প্রতিবেশীরা। ৩ থেকে ৪ মাস পর প্রতিটি ট্যাংকি থেকে ৪শ’ থেকে ৫শ’ গ্রাম ওজনের মাছ উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি মাছ বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর শিং মাছ কেজিতে ১০ থেকে ১২টি হয়।
চিরিরবন্দর থেকে ট্যাংকিতে মাছ চাষ দেখতে আসা নারী উদ্যোক্তা পলি বেগম (৩০) বলেন, খাদিজা আপার পানির ট্যাংকে মাছ চাষ দেখার জন্য আমি শিমুলতলী গ্রাম থেকে এসেছি। এতদিন জানতাম পুকুরে মাছ পালন হয়। এখন দেখছি বাড়ির আঙিনায় ট্যাংকিতে মাছ করা হয়েছে। আমিও আগামীতে ট্যাংকিতে মাছ চাষ করবো।
পার্বতীপুর পৌরসভার সাগর হল এলাকার তরুণ উদ্যোক্তা রাজু আহমেদ (২৭) ভাড়া নেওয়া জমিতে ট্যাংক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন। পেশায় তিনি একজন পল্লি চিকিৎসক। ৪ বছর আগে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় গড়ে তুলেছেন পার্বতীপুর অ্যাগ্রো ফার্ম ফিশারিজ। তার তিনটি ১০ হাজার লিটার পানি ও তিনটি ৩০ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাংকি রয়েছে। প্রতিটি ট্যাংকিতে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার পিস দেশি প্রজাতির মাছ উৎপাদন করছেন। তার এসব ট্যাংকিতে ভিয়েতনাম কই, শিং, তেলাপিয়া ও মাগুর মাছ চাষ করা হচ্ছে।
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের (জিবিকে)’র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহেদুল হক জানান, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে খাদ্য খরচ প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম। মাছের উৎপাদন হার পুকুর বা জলাশয়ের চেয়ে অনেক বেশি। এ পদ্ধতিতে চাষের ফলে মাছ দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাছের গুণগত মান উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত হয় এবং মাছের মৃত্যুহার নেই বললেই চলে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের ম্যানেজার (কার্যক্রম) এ এম ফরহাদুজ্জামান বলেন, শুকনো মৌসুমে যেখানে পুকুরে পানি থাকে না, সেসব এলাকার জন্য এ ধরণের মাছ চাষ পদ্ধতি লাভজনক। বিশেষায়িত পদ্ধতিতে পানি বারবার ফিলটার করে সম্পূর্ণরূপে পরিশোধিত করে মাছের ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো, অল্প ঘনত্বে অধিক মাছ উৎপাদন করা। যার ফলে পানি অপচয়ের সুযোগ নেই। এছাড়া মাছের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য অবশ্যই সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের সুব্যবস্থা রাখা অত্যাবশ্যক।
পার্বতীপুর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আবু জাফর মো. সায়েম জানান, পার্বতীপুর পৌরসভা ও উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে এখন ট্যাংকে উচ্চমূল্যের মাছ চাষ করা হচ্ছে। অনেকের পুকুর নেই। পুকুরে পানিও থাকেও না। কিন্তু এ পদ্ধতিতে ট্যাংকের অল্প পানিতে মাছ চাষ করা যায়। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পার্বতীপুরে ট্যাংক পদ্ধতিতে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।