শিরোনাম
।। বাবুল আখতার রানা ।।
নওগাঁ, ১২ মে ২০২৫ (বাসস) : স্থানীয় কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন মাকসুদুর রায়হান (৩০)। আর পড়ালেখা হয়ে ওঠেনি। দরিদ্র কৃষক বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে উচ্চ শিক্ষার চেয়ে দরিদ্র বাবার ঋণের বোঝা লাঘবের দায়িত্বই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছেন আর ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেছেন। আট বছর আগে টিউশনির ৪৬ হাজার টাকা দিয়ে প্রথমে গাভি কিনে গরুর খামার করার উদ্যোগ নেন। তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
জেলার আত্রাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম আটগ্রাম। ছোট যমুনা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ গ্রামে ৫০০ পরিবারে প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পারাপারই তাদের যোগাযোগের মাধ্যম। এ গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র। তাই শিক্ষার হারও কম। জীবন-জীবিকার জন্য কৃষিকাজসহ বিভিন্ন ছোটখাট পেশার সাথে জড়িত তারা। দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে টিকে থাকার প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় এ গ্রামের মানুষদের।
জেলা শহর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এবং আত্রাই উপজেলা থেকে পশ্চিমে ৮ কিলোমিটার দূরে এ গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা দরিদ্র কৃষক বেলায়েত হোসেন ও আলেয়া বেগমের পুত্র মাকসুদুর রায়হান। দুই ভাইবোনের মধ্যে রায়হান ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে।
বেলায়েত হোসেনের ৩ বিঘা ফসলি জমি। এক ফসলি এই জমিতে ইরি বা বোরো আবাদ হতো। যেবার বন্যা হতো ফসল আর ঘরে উঠতো না। বলা যায়, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এ পরিবার এবং এ গ্রামের বাসিন্দারা। তবে এখন তাদের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। গরুর খামার করে সফল রায়হান এখন গ্রামবাসীর কাছে রোল মডেল। তার দেখাদেখি অনেকেই এখন গরুর খামার করে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছেন।
মাকসুদুর রায়হান ২০১৯ সালে ইংরেজিতে অর্নাস সম্পন্ন করেন। ছাত্র জীবন থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এখন পুরোদমে কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন। এ গ্রামে দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করার চেষ্টা করছেন তিনি। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে চাকরির পেছনে না ছুটে হয়েছেন উদ্যোক্তা। টিউশনির ৪৬ হাজার টাকা দিয়ে ৮ বছর আগে একটি গাভি দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে তার খামারে শাহীওয়াল, ফ্রিজিয়ান ও ক্রস জাতের ১২টি গরু আছে। এছাড়া উন্নত জাতের ৪টি ছাগল রয়েছে। এর মধ্যে বিক্রির উপযোগী শাহীওয়াল ষাঁড়সহ চারটি গরু আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকার গরু-ছাগল আছে তার খামারে। গবাদি পশুকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে লালনপালন করা হয়। এছাড়া গাভি থেকে প্রতিদিন ১২-১৪ লিটার দুধ পাওয়া যায়। যা দিয়ে পরিবারসহ স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, রায়হানের গরুর খামারে বাঁশ ও কাঠের বেড়া এবং ছাউনিতে ব্যবহার করা হয়েছে টিন। ঘাসের চাহিদা মেটাতে সামান্য জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করা হয়েছে। জমিতে উৎপাদিত ধানের খড় থেকে বছরে কয়েক মাস চাহিদা পূরণ করা হয়। তবে বাকী সময়ের জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে খড় কিনতে হয়। খামারের গরু ছাগলের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসাও দেওয়া হয়ে থাকে। রায়হানের সাফল্য দেখে গ্রামের অনেকেই এখন উন্নত জাতের গরু পালন শুরু করেছে।
উদ্যোক্তা মাকসুদুর রায়হান বাসসকে বলেন, অভাবকে কাঁধে নিয়ে বড় হয়েছি। সামান্য জমিতে চাষাবাদ করে সামান্য আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে বাবা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন চিন্তা করতাম কীভাবে অভাবকে জয় করা যায়। ২০১৯ সালে ইংরেজিতে স্নাতক পাশ করি। এরপর চাকরির পেছনে না ঘুরে গরুর খামার করি। সেখান থেকে সফলতার শুরু। এখন আর আমার পরিবার ঋণগ্রস্ত না। আল্লাহর রহমতে সবাই ভাল আছি।
তিনি বলেন, অনেক খামারি পরিকল্পনা করে সুন্দর করে কংক্রিট দিয়ে খামার তৈরি করেন। এতে খামার তৈরিতে অনেক টাকা খরচ হয়। এতে টাকা অপচয় হয় বলে আমি মনে করি। অনেক সময় এসব বাড়তি খরচের কারণে প্রান্তিক খামারিরা টিকতে পারে না। এজন্য আমি কম খরচে বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দিয়ে শেড করেছি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে কম খরচে গবাদিপশু লালনপালন করছি। এতে খরচ কম এবং লাভ বেশি।
তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি কোন পরিবার যদি ঋণমুক্ত থাকে, তাহলে তাকে দারিদ্র বিমোচনের প্রথম ধাপ হিসেবে গণনা করা যায়। সেক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা হবে গবাদিপশু লালনপালন করা। এখন একটাই স্বপ্ন, নিজের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করা এবং তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা।
মাকসুদুর রায়হানের বাবা বেলায়েত হোসেন বলেন, এক সময় সংসারে খুবই অভাব ছিল। দুই সন্তানকে পড়াশুনা করাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ব্যাংক এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ছেলে পড়াশুনা শেষ করে সংসারের হাল ধরার পর এখন সচ্ছলতা ফিরেছে। ইচ্ছা আছে গরুর খামার বড় হলে হতদরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে গাভি দিয়ে সহযোগিতা করবো। তিনি জানান, এলাকার দুটি হতদরিদ্র পরিবারকে বিনামূল্যে দুইটি গাভি দিয়ে সহায়তা করেছেন। যাতে করে তাদের সংসারে কিছুটা হলেও স্বচ্ছলতা ফিরে আসে।
রায়হানের প্রতিবেশী আব্দুস সালাম বলেন, আগে আমার বাড়িতে ২-৩টি দেশী গরু লালন-পালন করতাম। কিন্তু মাকসুদুর রায়হান এর খামার দেখে উন্নত জাতের গরু পালন শুরু করি। এখন আমার খামারে ৬টি গরু আছে। গরুকে নিয়মিত চিকিৎসা প্রদানসহ তার কাছ থেকে সব ধরনের পরামর্শ নিয়ে থাকি।
নওগাঁ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাহফুজার রহমান বলেন, ‘ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পসুদে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ব্যাংক ও বীমার সাথে সমন্বয় করে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে খুব শিগগিরই প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জেনেছি। এতে উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস।’