শিরোনাম
আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল
চাঁদপুর, ১১ মে, ২০২৫ (বাসস) : ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য জেলায় গবাদি পশু সংকট দেখা দিয়েছে। এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য গবাদিপশুর চাহিদা রয়েছে ৭৬ হাজার ৩শ ৫৪ টি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বছর চাঁদপুর জেলায় মোট গবাদিপশু উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৮টি। কোরবানির জন্য চাহিদার তুলনায় গবাদিপশুর সংকট রয়েছে ১৪ হাজার ২শ ৫৬টি।
জেলার উৎপাদিত গবাদি পশু এবং কোরবানির চাহিদা অনুসারে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যদিও প্রতিবছর কোরবানির সময় লক্ষ্য করা যায় যে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গবাদি পশু আসে কোরবানির হাটে। এবছরও যদি অন্যান্য জেলা থেকে গবাদি পশু আনা হয় তবে এ সংকট থাকবে না মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে কিছু সংখ্যক খামারি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ভারতীয় গরু দেশের বাজারে আসলে খামারিদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে ।
কোরবানি উপলক্ষে ভারতীয় গরু যেন দেশের বাজারে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকটা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে এখন থেকে নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান চাঁদপুরের গরু খামারিরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় তালিকাভুক্ত খামারি রয়েছে ৩ হাজার ৭ শত ৭০ জন। খামারগুলোতে গরু উৎপাদন হয়েছে ৪২ হাজার ৪শত ৯৭টি। ছাগল ভেড়া ও অন্যান্য পশু উৎপাদন হয়েছে ১৯ হাজার ৬শত ১ টি। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৮টি।
জেলায় প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে কোরবানির পশুর যে চাহিদা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে কোরবানির জন্য গবাদি পশু প্রয়োজন ৭৬ হাজার ৩শ ৫৪টি। এ হিসেব মতে জেলায় গবাদি পশু সংকট রয়েছে ১৪ হাজার ২শ ৫৬ টি। চলতি বছর জেলায় ষাঁড় গরু উৎপাদন হয়েছে ২৪ হাজার ২শত ৪৭, বলদ ৭ হাজার ৭শত ৮১ , গাভি ১০ হাজার ৪শত ৬৯ টি। জেলায় সর্বমোট গরু উৎপাদন হয়েছে ৪২ হাজার ৪শ ৯৭ টি। মহিষ ২শত ১৭ টি, ছাগল ১৮ হাজার ৪শত ৫৮, ভেড়া ৮শত ৩০ ও অন্যান্য ৯৬টি।
চাঁদপুর সদর উপজেলায় গবাদি পশুর খামারি রয়েছে ৫ শত ১৪ জন। তাদের খামারে চলতি বছর মোট গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে ১০ হাজার ৬ শত ৩৫টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৪ হাজার ৮ শত ৩৬, বলদ ৩ শত ৯৯, গাভি ১ হাজার ৭ শত ৫৪, মহিষ ১ শত ৩০, ছাগল ৩ হাজার ৪ শত ১৬ এবং ভেড়া ১শ টি। এই উপজেলায় কোরবানির জন্য চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার ৬ শত ১৩ টি গবাদি পশু । চাহিদার তুলনায় গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ৯ শত ৭৮ টি।
মতলব দক্ষিণে খামারি রয়েছে ১ শত ৫৬ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ২ হাজার ৬ শত ৫১টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৮৭৩, বলদ ২৪৭, গাভি ১৭০, ছাগল ১ হাজার ৩ শত ১ এবং ভেড়া ৪৩টি। অন্যান্য পশু ১৭ টি । তথ্য অনুসারে এই উপজেলায় আসন্ন কোরবানির ঈদে গবাদিপশুর চাহিদা ২ হাজার ৬ শত ৫১টি । তাই এখানে গবাদি পশু ঘাটতি নেই।
মতলব উত্তরে খামারি রয়েছে ৩ শত ৬৪ জন। এই উপজেলায় মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ৪ হাজার ৮ শত ২টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ৭০, বলদ ৯ শত ১০, গাভি ৬ শত ৯৪, মহিষ ৬, ছাগল ৯ শত ৩০ এবং ভেড়া ৭৫টি। অন্যান্য গবাদি পশু ৭৫টি । এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ৫ হাজার ২শ টি। এখানে ৩ শত ৯৮ টি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ।
কচুয়া উপজেলায় ৩ শত খামারে মোট গবাদিপশু উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৩ শত ৬২টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ২ শত ২৮, বলদ ৭ শত ৩৯, গাভি ১ হাজার ৪ শত ৮, ছাগল ১ হাজার ৮ শত ৫৬ এবং ভেড়া ১ শত ৩১টি। এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ৬ হাজার ৯ শত ২২টি। গবাদি পশু ঘাটতি ৫ শত ৬০ টি।
শাহরাস্তিতে খামারি রয়েছে ৫ শত ৩৩ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ৬ হাজার ১ শত ৮৩টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ৫ শত ৭৬, বলদ ১ হাজার ১ শত ৩২, গাভি ১ হাজার ২ শত ৪১, মহিষ ৩৬, ছাগল ৯ শত ৫৮ এবং ভেড়া ২ শত ৪০টি। উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ১০ হাজার ৪ শত ৩৫টি। আর গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৪ হাজার ২ শত ৫২ টি।
হাজীগঞ্জ উপজেলায় খামারি রয়েছে ৫ শত ৫ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ৮ শত ৩৯টি। এরমধ্যে ষাঁড় ৪ হাজার ৪৪, বলদ ৪ শত ৫৫, গাভি ২ হাজার ৮ শত ৫৫, মহিষ ১০, ছাগল ৫ হাজার ৪ শত ৩০ এবং ভেড়া ৪৫টি। কোরবানির ঈদে গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ১৩ হাজার। এখানে ১ শত ৬১ টি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ।
ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খামারি রয়েছে ৬ শত ৮০ জন। এসব খামারে চলতি বছর গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে মোট ১৫ হাজার ৯ শত ৫০টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৬ হাজার ৫ শত ৭০, বলদ ৩ হাজার ৩ শত ৯৫, গাভি ১ হাজার ৮ শত ৬৫, ছাগল ৩ হাজার ৯ শত ৯৭, ভেড়া ১ শত ১৯টি। অন্যান্য ৪ টি। এখানে গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ২১ হাজার ২ শত ৩৩ টি। গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৫ হাজার ২ শত ৮৩ টি।
হাইমচরে খামারি আছেন ২ শত ৫৩ জন। এসব খামারে চলতি বছর গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে মোট ২ হাজার ৬ শত ৭৬টি।। এরমধ্যে ষাঁড় ১ হাজার ৫০, বলদ ৫ শত ৪, গাভি ৪ শত ৮২, মহিষ ৩৫, ছাগল ৫ শত ৭০ এবং ভেড়া ৩৫টি। এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৩ শত টি। এই উপজেলায় গবাদি পশু উদ্বৃত্ত আছে ৩৭৬ টি।
গবাদিপশুর ঘাটতির বিষয়ে সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের খামারি আব্দুল মান্নান বলেন, যেসব খামারি দশটা গরু পালন করতেন তারা এখন তিন থেকে চারটা গরু পালন করেন। গরু পালন করার যে খরচ হয় বিক্রির সময় সে খরচ ওঠানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এতে অনেক খামারি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণেই উৎপাদন কম হয়েছে।
রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের খামারি জসিম শেখ বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের সংসার খরচ চালাতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায় টাকা খরচ করা যাচ্ছে না। অনেকের কাছে জমানো টাকা ছিল না। ছিল গরু ছাগল। খরচ বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা এগুলো বিক্রি করে সংসার খরচ জোগাড় করেছে। এতে গবাদিপশুর উৎপাদন কমে গেছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার খামারি জসিম উদ্দীন মিন্টু বলেন, গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, খড়ের অপর্যাপ্ততা এবং শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও গবাদিপশু পালনে আগ্রহ হারাচ্ছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় আরো খামারি তৈরি করার জন্য পশুসম্পদ বিভাগকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন তিনি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার আরেক খামারি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন বলেন, আমি গত কয়েক বছর ধরে গরুর খামার করে আসছি। আমার খামারে গরুর পাশাপাশি ছাগল ও আছে। পশু খাদ্যের দাম হাতের নাগালে থাকলে আমাদের পশু পালন করে পোষাতো। কিন্তু এখন তেমন লাভ হয় না। তারপরও খামারের পিছনে অনেক টাকা লগ্নি করেছি বলেই চালিয়ে যাচ্ছি। গতবছর বন্যার ফলে খড়ের দাম অনেক বেড়েছে। তখন নিয়মিত খড় জোগাড় করতেও আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।
জানা যায়, গত কয়েক বছর যাবৎ কোরবানির জন্য মানুষের পছন্দ দেশি গরু। খামারিরা ভালো দাম পেয়েছে বাজারে। এই জেলায় পশুপালনে প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। খুব কম সংখ্যক লোক আছে যারা ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত খাদ্য খাওয়ায়। প্রাকৃতিক খাদ্য খাওয়ানোর কারণে এই জেলার গরুর চাহিদা বেশি। প্রতিবছর এ জেলা থেকে আশেপাশের জেলাগুলোতে গরু নেওয়া হয় হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে। এই জেলার কয়েকটি উপজেলা গরু পালনের জন্য প্রসিদ্ধ এগুলো হলো সদর উপজেলা, ফরিদগঞ্জ উপজেলা এবং মতলব উত্তর উপজেলা। সদর উপজেলাতে চরাঞ্চল থাকায় মানুষ সহজে গরু পালন করতে পারে। চরাঞ্চলে অনেক জমি আছে। এখানে প্রাকৃতিক ভাবে ঘাস জন্মায়। তাই এখানে গরু পালনে খরচ কম হয়। অন্যান্য খাবার কম প্রয়োজন পড়ে। আর ফরিদগঞ্জ ও মতলব উত্তর উপজেলায় জেলার সর্বোচ্চ ধান আবাদ হয়। গরুর প্রধান খাদ্য খড়ের উৎপাদনও বেশি। এখানেও গরু পালনে বাড়তি খরচ বহন করতে হয়না খামারিদের।
গতবছর কোরবানি ঈদ উপলক্ষে জেলায় ২২৫ টি পশুর হাট বসেছিল। এ বছরও সমপরিমাণ হাট বসবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: জ্যোতির্ময় ভৌমিক জানান, গতবছর কোরবানির জন্য যে পরিমাণে পশুর চাহিদা ছিল, এবছর চাহিদা তার চেয়ে বেশি হিসেব করা হয়েছে। চলতি বছর খামারিরা ভালো দাম পাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন। চাঁদপুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পশু পালন করায় পশুর চাহিদা অনেক। আশা করা যায় খামারিরা এবছরও লাভবান হবে।
তিনি বলেন, ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি উপজেলায় আমাদের মনিটরিং টিম রয়েছে। কোনো খামারি যাতে গরু মোটাতাজাকরণে অসদুপায় অবলম্বন না করে আমরা সেদিকে লক্ষ্য রাখছি।আমাদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক খামারে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণে সহায়তা করা হয়েছে। খামারিদের দেশীয় খাবার ব্যবহারে পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা প্রতিটি গরুকে ভ্যাকসিন দিয়েছি। আমাদের জেলায় সামান্য কিছু পশু সংকট রয়েছে। আমরা আশা করি ঈদে এ সংকট থাকবে না। প্রতি ঈদে আমাদের এখানে কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে গরু নিয়ে আসে হাটে তোলার জন্য। এ বছরও এভাবে হাটে গরু আসবে। তাই কাগজে-কলমে যেটুকু সংকট দেখা যাচ্ছে ঈদে তা থাকবে না।