বাসস
  ০৯ মে ২০২৫, ১৪:১৯

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অধিকাংশ স্লুইসগেট অকেজো, কৃষিকাজে বিপর্যয়ের শঙ্কা

ছবি : বাসস

এনামুল হক এনা

পটুয়াখালী, ৯ মে ২০২৫ (বাসস) : জেলার কলাপাড়ার অধিকাংশ স্লুইসগেট অকেজো হয়ে পরায় এলাকায় কৃষিকাজে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া অবশিষ্ট স্লুইসগেট থাকে প্রভাবশালীদের দখলে। তারা এসব স্লুইসগেট দখল করে মাছ ধরেন। ফলে কৃষকের প্রয়োজনে স্লুইসগেটের সুবিধা মেলে না। এসব নিয়ে চিন্তিত এই অঞ্চলের কৃষকরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কাঠালপাড়ার ছয় ভেন্টের স্লুইস গেটের দুই দিকের মূল পিলারের পলেস্তারা খসে পড়ছে। রডগুলো জং ধরে বেরিয়ে গেছে। কপাটগুলো লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে আছে। গেট থাকলেও খোলা। অনবরত লোনা পানি ওঠানামা করছে। সামনের দুই দিকের গাইডওয়াল অনেক আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। দুই দিকের নিরাপত্তা রেলিং ভেঙ্গে উধাও। পানি ওঠানামার সময় ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। মনে হয় এই বুঝি ধসে পড়বে। প্রত্যেকটি গেটের উপরে ঝোলানো রয়েছে বেহুন্দী জাল, যা দিয়ে মাছ ধরা হয়।

কলাপাড়া উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়ন ছাড়াও বরগুনার তালতলী উপজেলার কড়ই বাড়িয়া, পচা কোরালিয়া ও বগী ইউনিয়নের অন্তত ৩০ গ্রামের মানুষ কৃষিকাজে এই স্লুইসটি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু ৬৫ সালের দিকে নির্মিত এ স্লুইস গেটটি বর্তমানে জীর্ণদশায় পতিত হয়েছে।

এদিকে স্লুইসগেটসহ চলাচলের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কলাপাড়ার সঙ্গে তালতলীর তিনটি ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, স্লুইস গেট সংলগ্ন কচুপাত্রা নদীর দুই পাড়ের অন্তত ৩০ হাজার কৃষক কৃষিকাজ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। অথচ এ স্লুইস গেটের কপাটগুলোর সামনে জাল পেতে মাছ ধরে একটি মহলের দৈনিক আয় ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্লুইস গেটের আধিপত্য নিয়ে গত ২৫ বছরে দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে অন্তত ৩০টি। মামলা হয়েছে অসংখ্য। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের দখলে থাকে। এ থেকে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে অনেকের। কিন্তু স্লুইস গেটের জীর্ণদশার পরিবর্তন ঘটেনি। 

এলাকাবাসী স্লুইস গেটটি নতুন করে নির্মাণ করার দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, দ্রুত সংস্কার না হলে যেকোনো সময় এটি  বিধ্বস্ত হয়ে এলাকার ব্যাপক সর্বনাশ হতে পারে।  

এভাবে পক্ষিয়াপাড়া, মেলাপাড়া, পূর্ব-মধুখালী, চরপাড়া, সাফাখালী, নাচনাপাড়া, সুলতানপুর, লোন্দা, হাফেজ প্যাদা, পাটুয়া, দেবপুর, দশকানি, আনিপাড়া, গাজীর খাল, টিয়াখালী, ইটবাড়িয়া, সদরপুর, পূর্ব গৈয়াতলা, ডালবুগঞ্জ, সুলতানপুর, নজিবপুর, দরজার খাল, নিজামপুরসহ  অর্ধেকের বেশি স্লুইস  গেট কৃষকের কোন কাজে আসে না।

বর্তমানে বহু স্লুইসগেট অকেজো থাকায় খালবিলে লোনা পানির প্রবেশ ঘটেছে। অনেক কৃষকের রবিশস্য পর্যন্ত লোনা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। নীলগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুগীর স্লুইসগেট। ফি বছর স্থানীয় কৃষকরা নিজেদের অর্থায়নে লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে স্লুইস গেটটির রিভার সাইটের সংযোগ খালে বাঁধ দেয়।

এরপর ভিতরের দিকে খালের মিঠা পানি ব্যবহার করে ১২ মাস সবজির আবাদ করেন। কুমিরমারা, মজিদপুর ও এলেমপুর গ্রামের শতকরা আশি ভাগ কৃষক সবজির আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এ বিষয়ে কৃষক সুলতান গাজী জানান, তাদের গ্রামের উৎপাদিত সবজি কলাপাড়ার গোটা উপজেলার চাহিদার অর্ধেক জোগান দেয়। অথচ এই স্লুইস গেটটি যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও মেরামত করা হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকৃত কৃষকের নিয়ন্ত্রণে নেই শতকরা ৯০ ভাগ স্লুইসগেট। প্রভাবশালীরা অলিখিতভাবে মাছ ধরার জন্য লিজ দেয়। নিয়ম রয়েছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। যেখানে ইউপি চেয়ারম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা ও গ্রামের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রকৃত কৃষকদের অংশ গ্রহণে এই কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা করা হচ্ছে না। ফলে প্রকৃত কৃষকের ভোগান্তির শেষ নেই।

গ্রামের সাধারণ কৃষকরা জানান, এই স্লুইসের নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলের লোকজন। বিগত আওয়ামী লীগের সময় তাদের লোকজন জাল পাতা নিয়া রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আবার ওইদল যাওয়ার পরে অন্য লোকজন এসে এখন এসব স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, ইউএনও, ইউনিয়ন পরিষদ কারো এ নিয়ে কোনো চিন্তা নাই। আর জনপ্রতিনিধিরা প্রভাবশালীদের সঙ্গেই থাকে।

তারা বলেন, স্লুইসগেটগুলো মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে কৃষকের সর্বনাশ করে আসছে। এভাবে অন্তত অর্ধশত স্লুইসগেট এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন সিকদার বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে চম্পাপুর ও ধানখালী ইউনিয়নের অন্তত ১৩টি খাল ভরাট করা হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের উন্নয়নে খালবিল ভরাটের পাশাপাশি লালুয়ার মানুষের সর্বনাশ করা হয়েছে।  তিনটি ইউনিয়নের নয়টি স্লুইসগেট অচল হয়ে গেছে। মানুষ এখন জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। বসবাস করার পরিবেশ পর্যন্ত নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে,  কলাপাড়ায় ৪৭ টি ফ্লাসিং (এফএস), ৫৮টি ড্রেনেজ (ডিএস) এবং ২২ টি পাইপ-ইনলেটসহ ১২৭টি স্লুইসগেট রয়েছে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম জানান, এসব স্লুইসগেটের মধ্যে ১২ টি সম্পূর্ণ অকেজো। ৩০টি আংশিক খারাপ। এর আগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লতাচাপলী ইউনিয়নে ৪৮ নম্বর পোল্ডারের আটটি স্লুইসগেট নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আর নীলগঞ্জের নিচকাটায় আট ভেন্টের স্লুইসটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ৪৫ টি স্লুইসগেটের উভয় দিকের গেট সংস্কার করা প্রয়োজন। এছাড়া কাঠালপাড়ার স্লুইসটিও নতুনভাবে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কুমিরমারা গ্রামের কৃষকদের জন্য যুগীর স্লুইসটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এসব স্লুইসগেট মেরামত করা হবে বলেও জানান তিনি।