বাসস
  ০৬ মে ২০২৫, ১৭:৩৪

জিআই সনদ পেয়েছে নওগাঁর নাক ফজলি আম

নওগাঁর নাক ফজলি আম। ছবি : বাসস

নওগাঁ, ৬ মে, ২০২৫ (বাসস) : ফলের রাজা আম। অতুলনীয় স্বাদ আর পুষ্টিগুণে সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এই ফল। নাক ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আম্রপালি, ক্ষীরশাপাত, বারি-৪ ও গুটি জাতের আমের জন্য বাংলাদেশের বিখ্যাত জেলা হচ্ছে নওগাঁ।

তবে এবার নওগাঁর ‘নাক ফজলি আম’ পেয়েছে জিআই সনদ। এই আম বেশ বড়, লম্বা ও স্বাদে অতুলনীয়, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত হয়ে থাকে। নাক ফজলি আম বেশি হয় নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায়। এ খবরে জেলাবাসী উচ্ছ্বসিত।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বদলগাছী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাবাব ফারহান।

তিনি জানান, গত ১ মে বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় ‘নাক ফজলি আম’ চাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোজাফফর হোসেনের হাতে জিআই সনদ তুলে দেয়া হয়। সনদ হস্তান্তর করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

সাবাব ফারহান আরও বলেন, ‘নাক ফজলি আম‘ স্বাদে অতুলনীয়, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত। এটি শুধু একটি ফল নয়, বরং এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আমের স্বাদ, পুষ্টিগুণ ও বহুমুখী ব্যবহার সারা দেশে পরিচিতি এনে দিয়েছে। এর আগে বরিশালের আমড়া ও দিনাজপুরের বেদানা লিচুকে জিআই সনদ দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বদলগাছীর ‘নাক ফজলি আমের’ পক্ষে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরের জিআই নিবন্ধনের আবেদন করা হয়। পরে নওগাঁ জার্নাল নং ৫৬ প্রকাশিত হলে বিধিমতো দুই মাস অপেক্ষার পর কোনো পক্ষ থেকে বিরোধিতার নোটিশ না আসায় সনদ প্রদান করা হয়।

স্থানীয় কয়েকজন আম চাষিদের কাছ থেকে জানা যায়, এই আমের আসল নাম হচ্ছে ‘নাক ফজলি’। গঙ্গাতীরবর্তী কাশী বা বেনারস ভারতের প্রধান আম উৎপাদন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিনোদ কুমার লাহিড়ীর মাধ্যমে বদলগাছী উপজেলায় প্রথম বিস্তার লাভ করে নাক ফজলি। এ আমের নিচের দিকে নাকের মতো চ্যাপ্টা হওয়ায় এর নামকরণ হয়েছে নাক ফজলি। জোড় কলমের মাধ্যমে এ আমের চারা রোপণ করার ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে গাছে মুকুল আসে।

তৎকালীন ইংরেজ শাসক লর্ড লিটন ছিলেন বাংলার গভর্নর (১৯২২-১৯২৭) এবং স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের অস্থায়ী ভাইসরয়। তার আমলে এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ভাণ্ডারপুরে বিনোদ কুমার লাহিড়ী পরিবারের জমিদারি অঞ্চল ছিল।

প্রতি বছর জমিদার বিনোদ কুমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তীর্থে যেতেন ভারতে। ফেরার পথে সঙ্গে নানা ধরনের ফলদ গাছের চারা নিয়ে আসতেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কাশি ফজলি, বোম্বে ফজলি, দেবী ভোগ, মালদা ফজলি ও নাক ফজলি। যে এলাকা থেকে চারা নিয়ে আসতেন, সেই এলাকার নাম দিয়ে নামকরণ করতেন তিনি। এরপর থেকেই নাক ফজলি আম কলমের চারার মাধ্যমে আশপাশের গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে যেতে থাকে। এভাবেই আমটি পরিচিতি পায় ভান্ডারপুর গ্রামের বাইরে।

নওগাঁর দুবলহাটি ও বলিহার রাজবাড়ির বাগানেও এ আমের গাছ ছিল। জেলার বদলগাছী, ধামইরহাট, পত্নীতলা ও মহাদেবপুর উপজেলায় ব্যাপকভাবে নাক ফজলি আমের চাষ হচ্ছে। বদলগাছীর শ্রীরামপুর, দেউকুড়ী, কোলা, ভান্ডারপুর, দ্বীপগঞ্জ ও দুধকুরি গ্রামে এ আমের অসংখ্য বাগান গড়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে জমিদার বিনোদ কুমার লাহিড়ীর উত্তরসূরি নাতি শ্রী নিরঞ্জন লাহিড়ী বলেন, আমার দাদু বিনোদ কুমার লাহিড়ী বহুকাল আগে তীর্থভূমি কাশীতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে মুর্শিদাবাদের নবাবের বিখ্যাত আম বাগানে উদ্ভাবিত অতি উৎকৃষ্ট জাতের আম নাক ফজলি আমের কয়েকটি চারা বাংলাদেশে প্রথম এনেছিলেন। দাদু কয়েকটি নাক ফজলি আমের চারা সংগ্রহ করে ভান্ডারপুর নিজস্ব আম বাগানে রোপন করেন। এখন অনেকেই এই আমের খোঁজখবর নিতে আমাদের কাছে আসেন।

স্থানীয় বদলগাছীর বাসিন্দা আবদুল মান্নান জানান, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বিনোদ কুমার লাহিড়ী এ দেশ থেকে সপরিবার ভারতে চলে যান। আমার দাদা তার কলকাতার সম্পত্তি বিনোদ কুমারের সঙ্গে বিনিময় করায় এই জমিগুলো আমরা পাই। তার এখনো ৫ শতাংশ জমি রয়েছে এ দেশে। যেখানে তার উত্তরসূরিরা বসবাস করছেন। তাদের সেই জমিদারি আর নেই। এখন কৃষিকাজ করে চলেন উত্তরসূরিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, নাক ফজলি এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। গাছ পাকা নাক ফজলির ঘ্রাণ জন্ম দেয় অসাধারণ এক অনুভূতির। এ আমের আরেকটি বিশেষত্ব একটু শক্ত হওয়ার কারণে পচে না সহজে। গাছ থেকে নামানো নাক ফজলি দীর্ঘদিন ধরে ঘরে রেখে খাওয়া যায়।

তিনি জানান,  নাক ফজলি আম লম্বায় প্রায় চার ইঞ্চি আর চওড়ায় দেড় ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর নিম্নাংশ বাঁকানো। নাক বড় এবং স্পষ্ট বেরিয়ে আসা। আমটির গড় ওজন ৩০০ গ্রাম। আকারে অনেকটা বড় এবং নাক স্পষ্ট, এ কারণে এর নাম হয়েছে নাক ফজলি। নাক ফজলি শুধু নওগাঁ জেলায় পাওয়া যায়।

তিনি আরও জানান,  জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বদলগাছীর এই আমের পরিচিতি ও চাহিদা আরও বাড়বে।