বাসস
  ০৪ মে ২০২৫, ১৭:৩৭

দুগ্ধ খামারে আত্মকর্মসংস্থান ও স্বনির্ভরতায় কাশিমপুরের সাফল্যগাঁথা

ছবি: সংগৃহীত

মো. মামুন ইসলাম

রংপুর, ৪ মে, ২০২৫ (বাসস) : ভোরের আলো ফোটার পর কাশিমপুর গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে অভিন্ন এক দৃশ্য। ঘরের সামনে বেঁধে রাখা গাভী, মাঠের পর মাঠ সবুজ ঘাস আর দুধের কলস নিয়ে ব্যস্ত প্রায় প্রতিটি বাসিন্দা। যেন এক দুধের রাজ্য!

পীরগঞ্জ উপজেলার মিঠিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত কাশিমপুর গ্রাম। সদর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে এ গ্রামে অন্তত দুই’শ পরিবার বসবাস করে। তাদের বেশিরভাগই ছিল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। তবে এখন অধিকাংশ পরিবারই গরু পালন ও দুধ উৎপাদনে সরাসরি জড়িত। আর তাই কাশিমপুর নামের ছোট্ট গ্রামের নাম বদলে হয়েছে ‘দুগ্ধ গ্রাম’। এরই মাধ্যমে বদলে গেছে গ্রামবাসীর জীবনযাপন, অর্থনৈতিক অবস্থা আর স্বপ্ন দেখার প্রেক্ষাপট।

গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, দুগ্ধ খামার এখন গ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি পরিবারে সাধারণত তিন থেকে পাঁচটি গাভী রয়েছে। অপেক্ষাকৃত ধনী কৃষকরা ১০ থেকে ১২টি বা তারও বেশি গরু পালন করেন।

গ্রামটিতে ছোট বড় খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এই বিশাল পরিমাণ দুধ স্থানীয় ব্র্যাক চিলিং সেন্টার, তিনটি বেসরকারি খাতের দুধ ক্রয় কেন্দ্র এবং নিকটবর্তী পীরগঞ্জের মিল্ক ভিটা কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কাশিমপুরে গরু পালন শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে। কয়েকজন ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে তা শুরু করেন। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আশপাশের পরিবারগুলোও এ কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠে।  

ধীরে ধীরে এটি পরিণত হয় সামষ্টিক উদ্যোগে। 

৩৫ বছর বয়সী ইউনুস আলীর গল্পটা যেন স্বপ্নপূরণের মতো। দশ বছর আগে মাত্র একটি গরু নিয়ে দুধ উৎপাদন শুরু করেন তিনি। এখন তার খামারে ছয়টি দুগ্ধ গাভী রয়েছে, যেগুলো দৈনিক প্রায় ৬৫ লিটার দুধের যোগান দিচ্ছে। 

ইউনুস আলী বলেন, ‘গরু পালন আমাকে বদলে দিয়েছে। আজ আমার পরিবার স্বচ্ছল, আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।’

গ্রামের দুগ্ধ খামারের অন্যতম পথিকৃৎ চান মিয়া (৫৮) বাসস’কে তার সাফল্যের গল্প বলেন। তিনি জানান, ২২ বছর আগে তিনি নিজের সঞ্চয় দিয়ে একটি ফ্রিজিয়ান গরু কিনে খামার শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টা ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় তিনি ধীরে ধীরে খামারটি সম্প্রসারণ করেন। স্ত্রী শাহানা বেগম, দুই ছেলে শাহিন মিয়া (৩৫) ও স্বাধীন মিয়া (২৫) কে এ কাজে যুক্ত করেন। 

চান মিয়ার খামারে এখন ১২টি গরু রয়েছে। তার খামারে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। 

গর্বের সঙ্গে চান মিয়া বলেন, একা শুরু করেছিলাম, এখন আমার দুই ছেলে শাহিন আর স্বাধীনেরও আলাদা খামার আছে। 

দুই ছেলে সাতটি করে গরু পালন করে প্রতিদিন ৮০ লিটার করে দুধ বিক্রি করেন। বড় ছেলে শাহিন বলেন, ‘আমি এখন স্বাবলম্বী এবং আমার পরিবারের সঙ্গে সুখে শান্তিতে আছি।’ 

দুধ উৎপাদনে গরুর খাবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় কৃষকরা প্রায় ৪০ একর জমিতে নেপিয়ার, পাকচুং, সুইট জাম্বো এবং ভুট্টার মতো উচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড ঘাস চাষ করছেন, যা গরুর পুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস। কাশিপুরবাসীর এ সাফল্য উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনেরও দৃষ্টি কেড়েছে।

পীরগঞ্জ উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. ফজলুল কবীর বলেন, ‘গ্রামে ঢুকলেই মনে হয় যেন বিশাল এক খামারে এসেছি। গরুর দেখভাল, ঘাস কাটা আর দুধ সংগ্রহে সবাইকে ব্যস্ত দেখা যায়।’

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু সাঈদ বলেন, ‘সংগঠিতভাবে দুধ উৎপাদন করে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশপাশি দারিদ্র্য দূরীকরণের উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই কাশিমপুর গ্রাম।’

কাশিমপুরের প্রায় প্রতিটি পরিবার যেন একেকটি ছোট দুগ্ধ খামার। এতে পিছিয়ে নেই নারীরাও। সবার প্রচেষ্টায় গরুর দুধ উৎপাদন করেই ভাগ্য বদলেছেন, করেছেন স্বপ্নপূরণ। আর এর পেছনে রয়েছে কাশিমপুরবাসীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন। সংগঠিত উদ্যোগ ছোট্ট গ্রামকেও পুরো দেশের অনুপ্রেরণা বানাতে পারে, নীরব বিপ্লব ঘটাতে পারে, কাশিমপুর এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।