শিরোনাম

আব্দুর রউফ
ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ‘এমন জীবন তুমি করিও গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ কবি নজরুলের এই পঙক্তিটি যেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু পেছনে রেখে গেলেন কোটি মানুষের অশ্রুসজল ভালোবাসা। হাসিমুখেই তিনি বরণ করে নিলেন মৃত্যুকে, আর তাঁর বিদায়ে কাঁদছে পুরো বাংলাদেশ, কাঁদছে রাজনীতির আঙিনা।
মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যখন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান এই চরিত্রের বিদায়ে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়।
আজ বুধবার বিকেল ৩টায় যখন মানিক মিয়া এভিনিউতে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে তিল ধারণের জায়গাটুকু ছিল না। আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই তাঁর স্বামী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার জানাজায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা লাখো মানুষের স্রোত আজ মিশেছে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। তাদের চোখে জল, মুখে প্রিয় নেত্রীর জন্য দোয়া। কেউ এসেছেন উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে, কেউ বা দক্ষিণের নদীবিধৌত অঞ্চল থেকে। উদ্দেশ্য একটাই মমতাময়ী দেশনেত্রীকে শেষবারের মতো একনজর দেখা।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনটা ছিল রূপকথার মতো, আবার একই সঙ্গে ট্র্যাজেডিতে ভরা। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে তিনি কীভাবে দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হলেন, কীভাবে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠলেন, সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস।
১৯৮১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনীতির বাইরের মানুষ। দুই শিশুসন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে তিনি ছিলেন নিতান্তই এক শোকাতুর মা। কিন্তু দলের নেতাকর্মীদের দাবির মুখে ১৯৮২ সালে তিনি রাজনীতিতে পা রাখেন। সেই যে শুরু, এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। টানা ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৬ সালে যখন অনেক বড় দল আপস করে নির্বাচনে গিয়েছিল, খালেদা জিয়া তখন বলেছিলেন ‘না’। তিনি বলেছিলেন, স্বৈরাচারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। তাঁর সেই আপসহীন অবস্থানই তাঁকে স্থান করে দিয়েছিল সাধারণ মানুষের মণিকোঠায়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি জয়লাভ করে এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিশ্ব রাজনীতিতে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন হন। তাঁর শাসনামলে নারী শিক্ষা, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং অবকাঠামগত উন্নয়নে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। তবে তাঁর পথচলা কখনোই মসৃণ ছিল না। এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিনি যদি দেশত্যাগ করেন তবে তাঁর ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিদেশের মাটিতে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশই আমার সব। মরলে আমি এ দেশেই মরবো।’ তাঁর এই দেশপ্রেম তাঁকে আরও মহীয়ান করে তোলে।
রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ছিলেন এক অপরাজিত যোদ্ধা। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পৃথক পাঁচটি সংসদীয় আসনে এবং পরে তিনটি আসনে একসঙ্গে নির্বাচন করে সবকটিতেই জয়লাভ করেছেন। কোনো নির্বাচনেই তিনি কখনো পরাজিত হননি, যা গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক বিরল রেকর্ড।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ ভাগটা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ২০১৮ সালে মিথ্যে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়। অসুস্থ অবস্থায় দিনের পর দিন তিনি কারাবন্দি ছিলেন। পরে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও তিনি কার্যত গৃহবন্দিই ছিলেন। পরিবার থেকে তাঁর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া হলে, অনুমতি দেয়নি তৎকালীন সরকার। তবুও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না, ছিলেন অবিচল। তাঁর মুখ থেকে কখনো কোনো অভিযোগ বা হতাশার কথা শোনা যায়নি। তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখেছেন।
জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানকে কাছে পাওয়াটা ছিল তাঁর জন্য এক বড় প্রাপ্তি। দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে মায়ের মৃত্যুশয্যায় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারেক রহমান। মায়ের কফিনের পাশে বসে ছেলের কোরআন তিলাওয়াতের দৃশ্যটি আজ কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে তিনি হারিয়েছেন অনেক আগেই। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় কোকোর মৃত্যু এবং তাঁর লাশ দেখার জন্য গুলশানের কার্যালয়ে মায়ের অপেক্ষার সেই দৃশ্য আজও দেশবাসীর মনে গেঁথে আছে। আজ বড় ছেলে পাশে আছেন, নাতনি জাইমা রহমান আছেন, কিন্তু খালেদা জিয়া আর নেই।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় ছুটে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাদিক, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাত, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা ও ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিয়নপো ডি. এন ধুংগেল। এ ছাড়াও চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও কূটনীতিকরা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার শোকবার্তায় খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তাকে পাকিস্তানের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশ্বনেতাদের এই উপস্থিতি ও শোকবার্তা প্রমাণ করে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর প্রজ্ঞা, ধৈর্য এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সম্মানিত করেছিল।
আজকের এই শোকাবহ দিনেও তাঁর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কথা বারবার মনে পড়ছে সবার। তিনি কখনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি। এমনকি চরম বৈরী পরিস্থিতিতেও তিনি ছিলেন মার্জিত।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেকবার পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কখনো মাথা নত করেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ। তিনি জানতেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাঁর সেই অবস্থান যে কতটা সঠিক ছিল, তা পরবর্তীতে মানুষ প্রমাণ পেয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান হলো। ৫৪ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি ক্ষমতা ছাড়ার পরও নিজের সম্মান অক্ষুন্ন রেখেছিলেন এবং সুন্দর-স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর লিগ্যাসি ছিল তাঁর ধৈর্য। তিনি শিখিয়ে গেছেন কীভাবে চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের আদর্শে অটল থাকতে হয়।
তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে সিসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তখনও দেশবাসী তাঁর জন্য দোয়া করেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তিনি পূর্ণ মুক্তি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই স্বাধীনতার স্বাদ তিনি খুব বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি। তবে তিনি দেখে গেছেন স্বৈরাচারের পতন, যা হয়তো ছিল তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামের এক নীরব বিজয়।
খালেদা জিয়া শুধু একটি নাম নয়, তিনি ছিলেন দেশের অভিভাবক, গণতন্ত্রকামী মানুষের মা এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর ত্যাগ, দেশের মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাঁর আপসহীন ভূমিকা তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখবে।
তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন তাঁর কর্ম, তাঁর আদর্শ এবং অগণিত ভক্ত, সমর্থক আর অনুসারী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যত দিন গণতন্ত্রের আলোচনা হবে, যত দিন সংগ্রামের ইতিহাস লেখা হবে, তত দিন বেগম খালেদা জিয়ার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, এ দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। বিদায়, হে মহীয়সী। বিদায়, বাংলাদেশের রাজনীতির দীপ্তিময়ী নক্ষত্র।