শিরোনাম

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গণমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আজ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া বিবৃতির বরাত দিয়ে পত্রিকাটি খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। তবে, মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস উল্লেখ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান এই দেশটির ভাগ্য নির্ধারণে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলা দুই রাজনৈতিক পরিবারের এক ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটলো খালেদা জিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। তিনি তিন মেয়াদে দেশটির নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং আরেক রাজনৈতিক পরিবারের প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে পালাক্রমে ক্ষমতায় ছিলেন। এই দুই নেত্রীর পালাক্রমে ক্ষমতায় আসা-যাওয়াই দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে।
পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার উত্থান। তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পরপরই খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং দ্রুত বিএনপির নেতৃত্বে আসেন।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, জীবনের শেষ দশকে খালেদা জিয়াকে চরম রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার শাসনামলে তাঁকে যেতে হয় কারাগারে অথবা গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল একের পর এক মামলা। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস এবং লিভারের জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁকে প্রায়ই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হতো।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি জানায়, সরকার তাঁকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস আরো লিখেছে, গত বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর পর খালেদা জিয়া গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান এবং তাঁর বিরুদ্ধে করা প্রায় এক ডজন মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তবে, শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি হাসপাতালেই ছিলেন। হাসপাতালে থাকা সত্ত্বেও আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে বিএনপি তাঁকে তিনটি আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল।
হাসপাতালের বিছানা থেকেই খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার পতনকে ‘স্বৈরাচারের পতন’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদী ও অবৈধ সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, জনসমক্ষে এটিই ছিল তাঁর শেষ বক্তব্য।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে পত্রিকাটি জানায়, ১৯৪৫ বা ১৯৪৬ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহণকারী খালেদা জিয়া ১৯৬০-এর দশকে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সাধারণ গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনীতিতে আসেন। এরপর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
প্রতিবেদনে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথাও উল্লেখ করা হয়, যখন দুই নেত্রীই গ্রেফতার ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে জানায়, সেসময় শেখ হাসিনা দাবি করেছিলেন, খালেদা জিয়াকে ভালো সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা সরকার খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে, যা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দেখা হয়।
ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জননী। বড় ছেলে তারেক রহমান বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান ২০১৫ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ক্ষমতার রাজনীতির ইতিহাসে তিনি এক অবিচ্ছেদ্য ব্যক্তিত্ব।