বাসস
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৩২

খালেদা জিয়ার নীতি: বাম ও ডানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

সালাহ উদ্দিন শুভ্র

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক খুব জমজমাট ছিল। স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর গণতান্ত্রিক পথে তখন সবে চলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থায় প্রথমবার একজন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত সরকার বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করে। বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, উদার ও অর্থনৈতিকভাবে সচল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ওই উদ্যোগ অবশ্য সমালোচিত হয়।

এ উদ্যোগের সমালোচনা আসে বাম এবং আওয়ামী মহল থেকে। শেখ মুজিবুর রহমান তার একচ্ছত্র শাসনামলে সরকারি নিয়ন্ত্রণে শিল্প-কলকারখানা পরিচালনার নীতি অবলম্বন করেন। লুটপাট, অনিয়ম আর দেখভালের অভাবে দেশের অর্থনীতি তখন মুখ থুবড়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় বাংলাদেশকে আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করার উদার নীতি। পরে সেই উদার অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়া। এ ক্ষেত্রে সমালোচনাটা করেন মুজিবপন্থী অর্থনীতিবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিকরা। তাদের বক্তব্য ছিল বাজার উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে দেশীয় শিল্প মার খাবে এবং শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হবে না। তবে তাদের সমালোচনা ছিল ঠুনকো এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওই সময়ে বাংলাদেশেকে বার্হিবিশ্বের সঙ্গে যুক্ত না করলে দেশ আরও পিছিয়ে থাকত। পরবর্তী সময়ে যেসব উন্নতি হয়েছে সেগুলোর ভিত গড়ে দেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। সেটি ছিল ‘আকাশ সংস্কৃতি’ নিয়ে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট ক্যাবল নেটওয়ার্কের যুগে প্রবেশ করে। প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত সিএনএন, বিবিসি ইত্যাদি চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে। এভাবে বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রবেশের ঐতিহাসিক মুহূর্তকেও বিতর্কিত করা হয়। এ বিতর্ক প্রধানত শুরু করে প্রগতিশীলরা। তাদের বক্তব্য ছিল, বিদেশি চ্যানেলের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে। বিদেশি সংস্কৃতির দূষণ ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। এছাড়া বাংলাদেশি স্যাটেলাইট চ্যানেলও বিকশিত হতে পারবে না।

তাদের কথায় যুক্তি থাকলেও, বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বিদেশি চ্যানেলের প্রভাবে বাংলাদেশেও মিডিয়া বাজার গড়ে ওঠে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। টেলিভিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়।

খালেদা জিয়া এতটা দূরদর্শী হতে পেরেছিলেন মূলত তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। ১৯৯১ সালে যখন তিনি সরকার গঠন করতে যান, তখন তাঁর দলের আসন সংখ্যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য কম। ওই সময় একটি ইসলামপন্থী দলকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে সরকার গঠন করতে হয়। বিএনপি তাদের রাজনীতির শুরুতেও বিভিন্ন দল ও মতের ব্যক্তিকে দলটির সাথে যুক্ত করে। জিয়াউর রহমান যে পদ্ধতিতে শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘটনাবহুল হলেও তুলনামূলকভাবে কম জটিল ছিল। খালেদা জিয়ার সময়ে এসে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার কারণ বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সেই পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে প্রকাশ্য জোট বা সরকার গঠন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এটি ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। আর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকরের মাধ্যমে খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে বড় বিপদ থেকে রক্ষায় সমর্থ হন।

এক্ষেত্রে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে যা বোঝা সম্ভব হবে । যেমন তিনি ১৯৯৪ সালে গ্রামীণ মেয়েদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা ও বৃত্তি প্রদান নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়াশোনা বৃদ্ধি পায়। গ্রাম এলাকার মেয়েদের জন্য নতুন স্কুল, আলাদা টয়লেট সুবিধা এবং নারী শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগও নেন খালেদা জিয়া। প্রাথমিক শিক্ষাকেও বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ ছিল তাঁর। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ খালেদা জিয়ারই প্রতিষ্ঠিত নীতি। সাক্ষরতা ও বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমও চালু হয় তাঁর হাত ধরে।

একই সময়ে আশপাশের দেশ যেমন- পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি মিয়ানমারেও গোড়া ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী নারীশিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। সেসব দেশে নারীশিক্ষা বন্ধে জোরজবরদস্তি হয়। মালালা ইউসুফজাই একটি বড় উদাহরণ হতে পারে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। আফগানিস্তানের চিত্র কেমন তা লিখে বুঝানোর দরকার নেই।

মিয়ানমারেও নারী শিক্ষা বা নারীর উন্নতির হাল সবার জানা।

কিন্তু খালেদা জিয়ার দূরদর্শিতায় বাংলাদেশকে এ ধরনের বিপদে পড়তে হয়নি। তিনি একদিকে যেমন ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সরকার ও জোট গঠন করেছেন। অন্যদিকে নিজ দল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন সাবেক বামপন্থী নেতাদের। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদটি সবসময় ছিল সাবেক বামপন্থী নেতার দায়িত্বে। যাদের সমন্বয়ে তিনি একদিকে যেমন প্রগতিশীল অনেক নীতি গ্রহণ করতে পেরেছেন। আবার অন্যদিকে, এসব নীতির সঙ্গে রেখেছেন অন্যান্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের দল ও মতকে।

খালেদা জিয়া তাঁর এক ঐতিহাসিক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ডান কিংবা বামপন্থী আমরা নই। আমাদের ডানে যাদের অবস্থান তারা ডানপন্থী, আমাদের বামে যাদের অবস্থান তারা বামপন্থী। আমাদের অবস্থান ডানপন্থীর বামে এবং বামপন্থীর ডানে।’

অর্থাৎ বিএনপিকে তিনি মধ্যমপন্থী উদার একটি ধারার দল হিসেবেই গড়ে তুলেন। যার সাথে আমরা মিল খুঁজতে পারি ইংল্যান্ডের লেবার পার্টির। যদিও এর শুরুটা হয়েছে জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া বাকশাল নামক একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের পর বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগ ও ইসলামপন্থী দলের রাজনীতি ফিরিয়ে আনেন। তিনিই এই মধ্যম ধারার দৃষ্টিভঙ্গির সফল বাস্তবায়ন ঘটান। জিয়াউর রহমান যেমন ছিলেন চুপচাপ স্বভাবের খালেদা জিয়াও তাই। তাদের নীতি ছিল, কথা কম কাজ বেশি। এই বিরল যুগলের মধ্যে খালেদা জিয়া দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক নীপিড়ন, হয়রানি, প্রপাগান্ডার শিকারও হয়েছেন বেশি খালেদা জিয়া। আবার মধ্যপন্থী উদার ধারা প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানও সবচেয়ে বেশি।