বাসস
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২২

খালেদা জিয়া : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

মো. রহিম উদ্দিন

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপসহীন নেতৃত্বের নাম বেগম খালেদা জিয়া। এদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে তাঁর অসামান্য অবদান তাঁকে  সংগ্রামের এক মূর্ত প্রতীকে পরিণত করেছে। 

তিনি ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতিতে আসতে বাধ্য হন। ইতিহাসের এই নির্মম বাস্তবতায় কেবলমাত্র একজন গৃহবধূ থেকে রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হতে হয় তাঁকে। ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু।

আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই কেবল নেতৃত্বের অন্তর্নিহিত গুণাবলি ও দৃঢ় সংকল্পের ওপর ভিত্তি করে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন।

খালেদা জিয়া ১৯৮৩ সালের মার্চে বিএনপির ভাইস-চেয়ারপার্সন হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দল তাঁকে চেয়ারপার্সন নির্বাচিত করে। তিনি পরিণত হন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন অবয়বে।

দেশবাসী ও তাঁর সমর্থকরা তাঁকে ডাকতেন ‘আপসহীন নেত্রী’। এরশাদের স্বৈরশাসন অবসানের লক্ষ্যে ৯ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে খালেদা জিয়া অবৈধ সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আপস করেননি।

এরশাদ সরকারের শাসনামলে যে কোনো নির্বাচন, বিশেষ করে ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং জনগণকে তা প্রতিরোধের আহ্বান জানান।

অনেকের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘দেশনেত্রী’। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছে, তাদের কাছে তিনি ছিলেন প্রতিরোধের জীবন্ত প্রতীক।

খালেদা জিয়ার ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আরোহন ছিল এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। তিনি বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টো, বাংলাদেশের খালেদা জিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী তাঁদের নিজ নিজ দেশে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁরা বিশ্বের বহু নারীর জন্য আদর্শ হয়ে ওঠেন।

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১-১৯৯৫, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ নির্বাচনের পর সংক্ষিপ্ত সময় এবং ২০০১-২০০৫ এই তিন মেয়াদে বহু সংস্কার করেন, যা দেশকে পুনগর্ঠিত করে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্য ও বাধ্যতামূলক করা, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে পড়াশোনার সুযোগ এবং  ‘খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা’ কর্মসূচি চালু করা, যা হাজারো শিশুকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসে।

অর্থনৈতিক সংস্কারও ছিল তাঁর নেতৃত্বের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), বেসরকারীকরণ বোর্ড এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশে সহায়তা করেছে, সবই তাঁর শাসনামলে গড়ে ওঠে।

তিনি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে দেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। তাঁর সরকার মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে খুঁজে বের করে এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহস ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেয়। 

১৯৯৬ সালের স্বল্পস্থায়ী সরকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংস্কার আনে। তা হলো জাতীয় নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাংবিধানিক সংশোধনী।

ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেন, যা দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এক মাইলফলক।

বিশ্ব মঞ্চে তিনি সার্ক (দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা)-এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার চেষ্টা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো প্রধান বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

দু’বার তিনি বিরোধী দলীয় প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি তাঁর আপসহীন প্রতিশ্রুতি এবং ব্যক্তিগত ত্যাগের জন্য তিনি ‘গণতন্ত্রের মা’ হিসেবে ভূষিত হন।

নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের সিনেট ২০১১ সালে তাঁকে গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার জন্য ‘ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ উপাধিতে ভূষিত করে।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এমন রেকর্ড পাওয়া যায় না। কারণ নারীরা ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের রাজনৈতিক অধিকার পেয়েছেন মাত্র প্রায় ১০০ বছর আগে।

বেগম জিয়া ১৯৯১ সালে যখন ওআইসি সম্মেলনে প্রথম নারী সরকারপ্রধান হিসেবে ভাষণ দেন, তখন তা ইসলামী বিশ্বের অধিকাংশ নেতার জন্য ছিল এক অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা। সম্মেলনে তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম -এমন একটি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

দলীয় নেতৃত্বের ৩৫ বছরে তিনি কেবল গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না, বরং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদাকে হুমকির মুখে ফেলা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ঝুঁকি সত্ত্বেও সোচ্চার ছিলেন।

শেখ হাসিনার সরকার বেগম খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারের সদস্যদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছে। 

জাতির প্রতি তাঁর দীর্ঘ অবদানের ধারাবাহিকতায় বলা যায়, খালেদা জিয়া ও দেশ একে অপরের সমার্থক হয়ে উঠেছে।