শিরোনাম
\ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ \
কুমিল্লা, ২ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের ২ আগস্ট। শুক্রবার। কুমিল্লা নগরীতে দিনভর উত্তেজনা ও সতর্কতা বিরাজ করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আহত, গ্রেপ্তার ও নিখোঁজদের স্মরণে দেশব্যাপী ‘দোয়া, প্রার্থনা, কবর জিয়ারত ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র-জনতার অপ্রতিরোধ্য এক মিছিল। দোয়া ও প্রার্থনার হৃদয়গ্রাহী বাণীতে আবেগঘন হয়ে ওঠে এদিনের বৃষ্টিস্নাত শোক মিছিল। এদিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও আন্দোলনকারীদের পক্ষে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোও এদিন সশস্ত্র অবস্থানে থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় মহড়া ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। আন্দোলনকারীদের নানারকম হুমকি দেয় মিছিল না করার জন্য।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এদিন সকাল থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে কর্মসূচির প্রচার চালান এবং শহীদদের স্মরণে দোয়ার আয়োজন করেন। জুমার নামাজের পর নগরীর ঝাউতলা ছাতা মসজিদের সামনে থেকে শুরু হয় গণমিছিল। মিছিলটি পুলিশ লাইন্স, রেসকোর্স, বাদশা মিয়ার বাজার, পুলিশ লাইন্স স্কুল গেট হয়ে রেসকোর্স ফ্লাইওভার এলাকায় গিয়ে অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে শেষ হয়।
প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত শিক্ষার্থী অংশ নেন মিছিলে। ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আবু সাইদের রক্ত, বৃথা যেতে পারে না’,‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার!’-এমনই সব স্লোগানে প্রকম্পিত হয় কুমিল্লার রাজপথ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক প্রকৌশলী মো. রাশেদুল হাসান বাসসকে বলেন, ‘২ আগস্ট সকাল থেকে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীরা নগরীর বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নেয়। আমরা যেন কোনো কর্মসূচি পালন করতে না পারি সেজন্য তারা নানা হুমকি দেয়। তবে আমরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে কোনো ভয়-ভীতির কাছে নত হব না। আমরা জুমার নামাজের পর ছাতা মসজিদ থেকে মিছিল বের করি। প্রচুর বৃষ্টির মধ্যেও শত শত শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে আসে।’
রাশেদুল বলেন,‘আবু সাইদ শুধু একজন শহীদ নন, তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রতীক। তাঁর স্মরণে এই গণমিছিল ছিল আমাদের প্রতিরোধের বার্তা।’
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক ও লেখক নজরুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘চব্বিশের ২ আগস্ট ছিল এক বৃষ্টিভেজা প্রতিবাদের দিন। আবেগ, সংগঠিত প্রতিবাদ আর চাপা উত্তেজনার এক অনন্য মিশেল ঘটেছিল সেদিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহীদদের স্মরণে নগরবাসী সেদিন যে বার্তা দিয়েছে, তা কেবল কুমিল্লায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।’
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২ আগস্ট নগরীর প্রধান তিনটি পয়েন্ট টমছম ব্রিজ, কান্দিরপাড় ও পুলিশ লাইন্স মোড়ে সশস্ত্র অবস্থানে ছিল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে তারা খণ্ড খণ্ড মিছিল করে মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে গিয়ে জড়ো হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মীদের হাতে লাঠিসোঁটা ও রড দেখা গেছে। যা নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
এদিকে নগরজুড়ে ছিল পুলিশের কড়া নজরদারি। নগরীতে দুই পক্ষের কর্মসূচি থাকলেও কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সাদা পোশাকে ডিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। এ সময় পুরো নগরীজুড়ে চাপা উত্তেজনা ও থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে।
চব্বিশের ২ আগস্ট ছিল কুমিল্লার সাহস ও সংযমের দিন। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল, শহীদদের স্মরণে রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের দৃঢ়তা এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র মহড়ার মাঝেও সংঘাত এড়ানোর নাগরিক কৌশল সব মিলিয়ে কুমিল্লা দেখেছে একটি সংবেদনশীল, সংগঠিত ও ইতিহাসমুখী প্রতিবাদ দিবস। এই দিনটি কুমিল্লার আন্দোলনের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে।