শিরোনাম
মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি
ঢাকা, ৫ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর প্রতিবেদক মহিউদ্দিন মুজাহিদ মাহি’কে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘঠিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় আফসোস হলো—২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দিতে না পারা।’
আসিফ বলেন, ‘যদি সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে প্রথম কাজটি করতাম একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক রূপরেখা ও ঘোষণাপত্র তৈরি ও প্রকাশ। আমরা ভেবেছিলাম আন্দোলনটি দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধে যেতে হতে পারে। তবে সত্যি বলতে—ঘোষণাপত্র দিতে না পারাটা আজও আমার কাছে বড় আক্ষেপ।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ১৯৯৮ সালের ১৪ জুলাই কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকুবপুর ইউনিয়নের আকুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন এবং মাতা রোকসানা বেগম। তিনি নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
রাজনীতিতে তার সক্রিয় যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এরপর ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রথম সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় তিনি ও তার নেতৃত্বাধীন পুরো কমিটি পদত্যাগ করেন। একই বছর, ৪ অক্টোবর গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, কঠোর নজরদারি এবং জীবননাশের হুমকির মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় দেখান। আন্দোলনের গতিপথ রক্ষায় তিনি ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি একদিন এগিয়ে নেওয়ার মতো ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
গুম, নির্যাতন, নজরদারি এবং বহু সহযোদ্ধার মৃত্যু সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যান। নীচে তার একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো—
বাসস : আপনার রাজনীতিতে আসার গল্পটা কেমন? কেন আসলেন? কীভাবে আসলেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ২০১৮ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এসে যে জিনিসটা আমাকে প্রথম ধাক্কা দেয়, তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ বাস্তবতা। গেস্টরুমে নির্যাতন, ছাত্রলীগের একচ্ছত্র সন্ত্রাস—সবকিছু যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব নিয়ে কেউ কথা বলত না, সাহসও করত না।
ক্যাম্পাসে হাঁটতে গেলে হঠাৎ দেখা যেত—কলাভবনের সামনে বা টিএসসিতে একজনকে ১০-১২ জন মিলে মারছে, আর বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ প্রশ্ন করে না, কেউ জানতেও চায় না। সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনতাম, আগের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। নামাজ পড়লে, প্যান্ট টাকনু উপরে রাখলে শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর করা হতো। এভাবে একটা অব্যক্ত ভয়ের পরিবেশে আমরা ক্যাম্পাসে আসি। এই বাস্তবতা মেনেই চলতে হতো।
যাহোক এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালের শুরুর দিকেই। তখন ব্যক্তিগতভাবে, বন্ধ-ুবান্ধবের ছোট একটি সার্কেল নিয়ে আমি আন্দোলনে যুক্ত হই।
এই যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রথমবার বুঝতে পারি—প্রতিবাদ করাও সম্ভব, কণ্ঠস্বর তোলা যায়। এরপর থেকে আমরা শুধু কোটা ইস্যু না, ক্যাম্পাসের গেস্টরুমে নির্যাতন, ছাত্রলীগের দখলদারি, জাতীয় ইস্যু—যেমন আবরার ফাহাদের শাহাদাত, এনআরসি, গুম-খুন, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছি। আমরা সংখ্যায় কম ছিলাম—১০, ১৫, কখনো ২০ জন। কিন্তু কোনো আন্দোলনেই অনুপস্থিত থাকিনি।
প্রথমদিকে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু সেখানে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটা সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে নেতৃত্ব নিয়ে কৌশলগত ও আদর্শিক বিরোধ তৈরি হলে আমি পদত্যাগ করি। এরপর আমরা ‘ছাত্রশক্তি’ গঠন করি। ছাত্রশক্তি গঠনের ১০ মাস পরেই আমরা আবার নতুনভাবে সংগঠিত হই এবং সেখান থেকে ভবিষ্যতের অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব আসতে থাকে।
বাসস : আন্দোলন করতে গিয়ে আপনি কি কখনো ভয় বা হামলার সম্মুখীন হয়েছেন? সেই অভিজ্ঞতাগুলো কেমন ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১৩৬ জন ভর্তি হওয়ার ঘটনা সামনে আসে। আমি নিজে সেই তালিকা তুলে ধরি সামাজিক মাধ্যমে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিল না। এরপর আন্দোলন হয়, প্রশাসন তদন্ত করে প্রায় ৯০ জনকে বহিষ্কার করে। সেই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই। আমার চোখে আঘাত লাগে, এখনও দাগ আছে। তখনই বুঝি, ভয় একবার কাটলে আর ভয় থাকে না।
এরপর আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবছর তাকে স্মরণ করতাম। মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিই, আবার আহত হই। ২০২২ সালে আবরারের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায় আবারো হামলা হলে আমি আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হই। পরে সেখান থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় দেড় মাস জেলে ছিলাম। আমার নামে চারটি মামলা ছিল, যার মধ্যে দুইটা আবরার ইস্যুতে, বাকি দুইটা অন্য ঘটনায়। প্রতি মাসে সিএমএম কোর্টে হাজিরা দিতে হতো— এটাই হয়ে গিয়েছিল জীবনের রুটিন। এই সময়টাতে অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি— কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে। কেউ আইনি সহায়তা দিয়েছে, কেউ আর্থিক। সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অনেক বড় ভাই সহযোগিতা করেছেন।
বাসস : জুলাইয়ের আগেও আপনাকে একাধিকার কারাবরণ করতে হয়েছিলো? কারাগারে অবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমি যখন প্রথম গ্রেপ্তার হই, তখন আমরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলাম। আবরার স্মরণসভায় ছাত্রলীগ হামলা চালায়, এরপর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকেই ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের জন্য সহজ কিছু অপেক্ষা করছে না।
কারাগারে যাওয়ার পর প্রথম যে অনুভবটা হয়, তা হলো— নির্জনতা আর বিচ্ছিন্নতা। মনে হচ্ছিল, বাইরের জগৎটা থেমে গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম, এখানে থেকেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আমি কারাগারে যাওয়ার পর পরিবার, বন্ধ-ুবান্ধব, সংগঠনের সহযোদ্ধারা চিন্তায় পড়ে যায়। মা-বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন।
কারাগারে ভেতরে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। প্রথমদিকে আমাদের আলাদা করে রাখা হলেও পরে মিলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে দেখেছি, অনেক কয়েদি আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা জানতে চাইত, ‘তোমরা কোন রাজনীতির সঙ্গে আছো?’, ‘কেন ধরা পড়লে?’—তাদের মধ্যেও একধরনের কৌতূহল ছিল। কেউ কেউ বলত, ‘ভাই, ভালো কাজ কইরা ধরা খাইছো।’
কারাগারে বই পড়ার চেষ্টা করতাম। পরিবার বই পাঠাতো, বন্ধুদের পাঠানো চিঠি পেতাম। সেই চিঠিগুলো ছিল বেঁচে থাকার শক্তি। একজন প্রগতিশীল লেখক আমার নামে কারাগারে কবিতা পাঠিয়েছিলেন, সেটা আমাকে নতুন উদ্দীপনা দেয়।
সবচেয়ে যেটা উপলব্ধি করেছি, সেটা হলো— প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করতে হলে আগে তার সাহস ভাঙতে হয়। জেলে রেখে সেটাই করা হয়। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম— বেরিয়ে আবার আন্দোলনে ফিরব। জেল থেকে বের হওয়ার পরে আমি একদিনও বিশ্রাম নিইনি। পরদিনই মাঠে নেমে পড়ি। কারণ আমি জানতাম, সংগ্রাম এখন আরও গভীর হয়েছে। আমাদের শত্রুরা এখন জানে— আমরা ভয় পাই না।
বাসস : ২০২৫ সালের জুলাই আন্দোলনে আপনার সম্পৃক্ততা কীভাবে শুরু হয় এবং তা কীভাবে বিস্তৃত হয়?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : জুনের ৫ তারিখ যখন রায় ঘোষণা করা হয় তখন আমি ছিলাম চানখারপুলের বাসায়। হান্নান মাসুদ আমাকে ফোন করে বলে, ‘ভাই, এটা নিয়ে তো প্রতিবাদ দরকার।’ আমি তখনই বুঝতে পারি, ২০১৮ সালের আন্দোলনের সঙ্গে এই রায়ের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। কারণ তখন আন্দোলনের ফলে আংশিকভাবে কোটা সংস্কার হয়েছিল, আর এখন সেটাকে পুরোপুরি উল্টে দেওয়া হয়েছে। সেইদিন সন্ধ্যায় আমরা লাইব্রেরির সামনে কর্মসূচি দেই। ভেবেছিলাম কয়েকজন হয়তো আসবে। কিন্তু আশাতীতভাবে সবাই অংশ নেয়, সেখান থেকে আত্মবিশ্বাস জন্মায় যে এই আন্দোলন আমরা সফল করতে পারি।
ঈদের ছুটির সময় বুঝতে পারি, এটা দীর্ঘ আন্দোলন হতে চলেছে। তখন সিদ্ধান্ত নিই— যদি দাবি আদায় না হয়, তাহলে ব্যানার তৈরি করব। শুরু হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ, নেটওয়ার্ক তৈরি, ফেসবুক গ্রুপে সংগঠিত কার্যক্রম। জুনিয়রদের বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছুটির সময় অনলাইন মিটিং চলত নিয়মিত।
প্রথমদিকে অন্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার পর, বিশেষ করে বাংলা ব্লকেড শুরু হওয়ার সময়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানার তৈরি হয়, তখন সবাই এক প্ল্যাটফর্মে আসে। এরপর আন্দোলন তিনটি ধাপে এগোয়।
প্রথমে ছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। কিন্তু আন্দোলনকারীদের পেছনে কোনো বড় রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। যারা রাজনীতির বাইরে ছিল, তারা সবসময় দ্বিধায় ছিল—আসলে কি সরকারের বিরুদ্ধে যাব? কেউ কেউ বলত, ‘তোমরা তো বিসিএস দিবা না, তাহলে আন্দোলনে তোমাদের লাভ কী?’ আবার কেউ বলত, ‘সরকারবিরোধী অবস্থান নিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভুগবে।’ এই দ্বিধা ছিল সত্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে যেহেতু সরকার পক্ষ থেকে দমনপীড়ন বাড়তে থাকে, ১৫ তারিখে হামলা, ১৬ তারিখে আবু সাঈদসহ ছয়জন শহীদ হন, তখন আন্দোলনের গতি পাল্টে যায়। তখন এটা আর শুধুই কোটা সংস্কারের আন্দোলন থাকে না, এটা হয়ে যায় একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই।
বাসস : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলার পর আন্দোলনের স্বরূপ কীভাবে বদলে যায়? এর পেছনে রাজনৈতিক বাস্তবতা কী ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের সরাসরি হামলার পর, এবং পরদিন আবু সাঈদ ও ওয়াসিমসহ সাতজন শিক্ষার্থীর শাহাদাতের প্রতিবাদে যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছিল, তা একদিকে সহিংসতার দিকে গড়ায় এবং অন্যদিকে এটি সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। যেমন আপনি বললেন, ২০১৮ সালের আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল— ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই’ বলে একটি দাবি তুলে সরকারের ছত্রছায়ার ভেতরে থেকেই একটি দাবি আদায়ের চেষ্টা। কিন্তু এবার আমরা পুরোপুরি এক ধরনের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় চলে গিয়েছিলাম। সরকারের সামনে দাঁড়িয়ে তার অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। এই ট্রানজিশনটা কীভাবে হলো, সেটা বুঝতে হলে আমাদের ভেতরের দ্বন্দ্বটাও বুঝতে হবে।
২০১৮ সালের আন্দোলনের তুলনায় এবার আমরা শুরু থেকেই রেজিস্ট্যান্সে গিয়েছি। আন্দোলনের এই ট্রানজিশন পিরিয়ডটা ছিল আমার জন্য খুব কঠিন সময়। একদিকে বাইরে থেকে আঘাত আসছিল, আমাদের খুঁজে বেড়ানো হচ্ছিল, মামলা হচ্ছিল, গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিলাম। অন্যদিকে, ভেতরেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল—কাকে বিশ্বাস করব, কে আসলে সরকারের পক্ষের, কে আমাদের সঙ্গে থাকবে না—এসব নিয়ে দোটানা তৈরি হয়।
কিছু জায়গায় এমনও হয়েছে, যেমন সায়েন্স, রোকেয়া বা শামসুন্নাহার হল—সেখানে যারা আন্দোলনের সংগঠক, তারা নিজেরাই দ্বিধায় ছিল যে আন্দোলন সরকারবিরোধী হয়ে গেলে তারা অংশ নেবে কিনা। আমাদের প্রোগ্রাম ডাকলে মানুষ আদৌ আসবে কিনা, এটা নিয়েও সংশয় তৈরি হতো। কিন্তু নৈতিক জায়গায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এটা শুধু কোটার প্রশ্ন ছিল না। এর পেছনে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্ষোভ, আওয়ামী লীগের প্রতি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কাজ করছিল। তাই আন্দোলন যখন সরকারবিরোধী রূপ নেয়, তখন তা একটা বৃহত্তর কাঠামোয় পরিণত হয়।
এটা আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। সেই সময় নানা সংস্থা আমাদের সঙ্গে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই সরকারবিরোধী রাজনীতি, জেল-জুলুম, রিমান্ডে অভ্যস্ত ছিল। তাই তাদের জন্য এটা নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু যারা সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে, যাদের অতীতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই, তাদের জন্য এই চাপটা অনেক বেশি কঠিন ছিল। এজন্য অনেক সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল। যেমন— প্রেস রিলিজে বক্তব্য বদলে ফেলা, কাউকে দিয়ে অন্যরকম কথা বলানো— এসব ঘটেছে।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে পুরো আন্দোলনটি কখন এবং কীভাবে সরাসরি সরকারবিরোধী রূপ নেয়? সেই রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি কীভাবে ঘটেছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ১৬ জুলাইয়ের দিকেই আমরা কিছুটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসি। কয়েকবার আলোচনার পর, আমরা সবাই মোটামুটি একমত হই যে এখন আন্দোলনের দাবি হবে—শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, আরও চারজন মন্ত্রীর পদত্যাগসহ সাত-আট দফার একটি তালিকা। পরে এগুলো কম্পাইল করে একটি আট দফা প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়।
আমার মনে আছে, সেদিন রাতে নাহিদ ভাই আর আমি দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ি। তখন জুনিয়ররা কাদের ভাই এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সেই আট দফা প্রস্তাবনা ঘোষণা করে। এই আট দফা ছিল একটা কমপ্রোমাইজড ভার্সন, কিন্তু নেতৃত্ব না থাকলেও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
এই আট দফা ঘোষণার আগেই, ১৬-১৭ তারিখ থেকেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ধরনের কিছু ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু আমরা একদমই রাজি হইনি। আমাদের জুনিয়ররা এই জায়গায় অত্যন্ত সজাগ ছিল। এটাই আমাদের গর্বের জায়গা— তারা আমাদের কাছ থেকে রাজনীতি শিখেছে এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্যাম্পাস এবং হল বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমাদের প্রধান প্ল্যাটফর্ম— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষ করে শহীদ মিনার আমরা হারিয়ে ফেলি।
ফলে আমরা একরকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। তখন আমাদের স্লোগানগুলো পরিবর্তিত হতে থাকে—‘বাংলাদেশের জনগণ নেমে আসুন, নেমে পড়ুন’ ‘এই দেশ আপনারও’—এভাবে আমরা সরাসরি জনগণকে অ্যাড্রেস করতে শুরু করি।
আন্দোলনের ফোকাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরে জাতীয় প্ল্যাটফর্মে চলে যায়। তখন আমাদের কর্মসূচিও জাতীয় রূপ নেয়। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ছিল দেশব্যাপী কর্মসূচি।
আমি নিজের চোখে দেখেছি—ঢাকার অলিগলিতে দোকানদাররাও শাটার নামিয়ে রেখেছে ছাত্রদের সমর্থনে। সেদিন আমরা শাটডাউনের ঘোষণা দিয়েছিলাম এক ধরনের ‘ট্রিক’ করে। আমরা অবাকও হয়েছিলাম, কারণ এতো বড় অংশগ্রহণ আমরা নিজেরাও প্রত্যাশা করিনি। বিশেষ করে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমরা ধারণা করেছিলাম যে হয়তো আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা হয়েছে।
আমরা তখন স্পষ্টভাবে দেশের মানুষ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসার ছাত্র, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আহ্বান করছিলাম। মিডিয়ার মাধ্যমে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছিল। এতে প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শামিল হয়।
এটা স্পষ্ট যে ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া ছিল তৎকালীন সরকারের এক মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ এতে আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ে এবং আমরা ক্যাম্পাস হারালেও পুরো বাংলাদেশকে আমাদের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করি।
বাসস : ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকার সময় আপনারা কীভাবে আন্দোলনের সমন্বয় ও যোগাযোগ বজায় রাখতেন? তখনকার পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ১৭ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলন পুরোপুরি সমন্বিত ও সংগঠিত ছিল। কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা মূল নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম, ফিজিক্যালি উপস্থিত থাকতাম। কিন্তু এরপর থেকে আন্দোলনটা হয়ে যায় একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। অনেক জায়গায় স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। আমরা চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব কেন্দ্র থেকে দিকনির্দেশনা দিতে। যেমন, কুমিল্লার আন্দোলন— আমাদের সময় মিলত না তাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখার। কারণ তখন আমাদের ফোন বন্ধ রাখতে হতো, লুকিয়ে থাকতে হতো। এই ধরনের পরিস্থিতি হয়ে গিয়েছিল। তবুও কেন্দ্রীয়ভাবে যেসব কর্মসূচি দেওয়া হতো, মানুষ সেগুলো বাস্তবায়ন করেছে দেশব্যাপী। এটা দেখেই বোঝা যায়, এই আন্দোলনটা জনগণের ছিল, নেতারা শুধু তার পথনির্দেশক।
তবে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ থাকার সময়ের পরিস্থিতি আমি যতটুকু শুনেছি সেখান থেকেই বলছি, কারণ ১৯ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত আমি প্রায় ঘুমের মধ্যে ছিলাম। পরে যখন বের হয়ে এলাম, তখন বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি ঘটছে। আমি যখন বের হয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম, সেখানে ব্রডব্যান্ড কানেকশন ছিল, যদিও ইন্টারনেট অন ছিল না। ব্রডব্যান্ড অন থাকার কারণে আমি দেখতে পেরেছিলাম ওই সময়ের মধ্যে কী কী ঘটেছে। আট দফা নয় দফা—এর পর যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২১০ জন। আমি ঘুমানোর আগে জানতাম মোট সাতজন নিহত হয়েছেন, আর ২৯ জন আহত হয়েছেন।
আমি ভাবছিলাম হয়তো সংখ্যা হবে ৫০-এর মতো, কিন্তু ২১০ দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। ওই সময় নাহিদ ভাইও ছিলেন না, আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম না।
তখন জুনিয়ররা মোটামুটি অর্গানাইজ করার দায়িত্ব নিয়েছিল এবং স্টেকহোল্ডারদের পাশাপাশি অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ তারা রক্ষা করছিল।
পরবর্তীতে নাহিদ ভাই দুইদিন পর আহত অবস্থায় মুক্তি পান। এরপর কিছুটা কোঅর্ডিনেশন করলেও আমি আসার পর আমরা ফোনে যোগাযোগ করে কর্মসূচি দিতে শুরু করলাম। রিফাত, মাসুদ, হাসিব সবাইকে ফোনে বলতাম। আমরা দুজনে তখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। আমার জন্য ওই সময়টা খুবই সংকটময় ছিল। ২৪ তারিখ আমি গণস্বাস্থ্যে ভর্তি হই, ২৬ তারিখ আবার ডিবিতে চলে যাই।
বাসস : আপনাকে কতবার তুলে নেওয়া হয়েছিল এবং সেই সময় কী ধরনের পরিস্থিতি ছিল? আপনি কোথায় ছিলেন, কী দেখেছিলেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমাকে মোট দুইবার তুলে নেওয়া হয়— প্রথমবার একটি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে, দ্বিতীয়বার ডিবির (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) মাধ্যমে। প্রথমবার আমি গুলশানে এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম। গুলশান মোড়ে তখন গোলাগুলি হচ্ছিল। আমরা গলিতে বের হয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম, কিছু করারও চেষ্টা করছিলাম।
কিন্তু রাস্তাগুলো সোজা হওয়ায় পুলিশ ফায়ারিং লাইন তৈরি করে ফেলেছিল। আশ্রয়ের কোনো সুযোগ ছিল না, ব্যাকআপ নেওয়ারও সুযোগ ছিল না।
সেদিন রাতে আমি হাতে একটি প্রেস রিলিজ লিখে এক বন্ধুর হাতে দিই। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমরা বিভিন্ন মিডিয়া হাউসকে ফ্যাক্সের মাধ্যমে সেটি পাঠানোর ব্যবস্থা করি—আমার বন্ধুর বাবার অফিস থেকেও ফ্যাক্স পাঠানো হয়। পরে লোকেশন পরিবর্তনের জন্য আমি মিরপুরের আরেক বন্ধুর বাসায় যাই। যাওয়ার আগে ফোনে তাকে জানিয়েছিলাম। তখনই আমাকে ট্রেস করে তুলে নেওয়ার চেষ্টা হয়। পরে জানতে পারি, আমাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সেখানে আমাদের ভিডিও বার্তা দিতে বলা হয়, যাতে বলা হবে—আন্দোলন বন্ধ করা হচ্ছে, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হবে। তারা দাবি করে, বিএনপি-জামায়াত এই সহিংসতার পেছনে রয়েছে।
আমি সেই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি। পরে তারা আমার ফোনের পাসওয়ার্ড নিয়ে তা চেক করতে থাকে। রাজি না হওয়ায় কয়েক ঘণ্টা পর তারা আমাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রাখে। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ব্লাড টেস্টে জানা যায়—আমাকে প্যাথেডিন দেওয়া হয়েছিল এবং তারা তিন-চারবার ইনজেকশন দিয়েছিল।
আমি প্রায় পুরো সময়ই অচেতন ছিলাম। ছেড়ে দেওয়ার আগের রাত থেকে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পাই। সেই রাতে তারা আমার ফোন থেকে পরিবারের সদস্য ও সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কাউকে পায়নি। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আমি দুই দিন বন্দি ছিলাম। সেখানেও গোয়েন্দারা আমাদের কেবিনে আসত। আমরা ফোনে ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে জুনিয়র এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তারা বুঝে ফেললে আমাদের ফোন কেড়ে নেয়।
পরদিন ডিবির গাড়িতে করে আমাদের আরেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে আমরা তিনজন— আমি, নাহিদ ভাই ও বাকের ছিলাম। পরদিন হাসনাত ভাই, সারজিস ভাই এবং নুসরাতকেও আনা হয়। শুরু থেকেই তারা আমাদের ভিডিও সাক্ষাৎকার দিতে চাপ দিতে থাকে— কখনো মানসিকভাবে, কখনো শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।
আমরা একে অপরের সঙ্গে সীমিত সময়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারতাম—প্রতিদিন মাত্র ১০-২০ মিনিট। বাকি সময় সবাইকে আলাদা করে রাখা হতো। তারা আমাদের চাপ দিচ্ছিল যেন আমি তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কথা বলি।
আমরা দেখতে পাই, মাসুদ, কাদের, রিফাতকে খোঁজার জন্য টিম পাঠানো হচ্ছে। আমাদের ভয় হচ্ছিল, একে একে সবাই যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে আন্দোলন থেমে যাবে। বাইরের পরিস্থিতির খবর আমরা পাচ্ছিলাম না।
একদিন পুলিশ কনস্টেবল জানায়, শিক্ষকরা আসছেন। তখন মাহিন আমাকে ফোন দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই— তারা যেভাবে ভিডিও বার্তা চায়, তা আমরা প্রেস ব্রিফিং আকারে দেবো। হারুন বলেন, আগে ভিডিও রেকর্ড করে তারা দেখে নেবে, তারপর আমরা মিডিয়ার সামনে যাবো।
তারা একটি স্ক্রিপ্ট তৈরি করবে যেখানে বলা থাকবে— আন্দোলন বন্ধ হচ্ছে, সহিংসতা বন্ধ হবে। কিন্তু ওই বক্তব্য কেউ আগেই পড়ে দেখেনি, সই দেওয়ার আগেও টেক্সট আমাদের জানানো হয়নি। আমরা ভাবছিলাম, নিজের মতো করে কথা বলার সুযোগ থাকবে। কিন্তু সেটি একতরফা লেখা ছিল এবং পরে তারা সেটি মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। পুরো প্রেস ব্রিফিং ফোন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়— ডিসি রমনার অফিসে। তিন দিন ধরে তারা আমাদের আটকে রাখে এবং বলে, তাদের কথা না বললে তারা আমাদের ছাড়বে না।
বাসস : আপনার বন্দিত্বকালীন অনুপস্থিতি ও পরে মুক্তির পর আন্দোলন কীভাবে পুনরায় সংগঠিত হয় এবং এক দফা ঘোষণার প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন হয়?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমরা বহুবার আমাদের জুনিয়র ও সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমাদের ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর প্রবল চাপ ছিল, এবং আমরা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখে পড়েছিলাম। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা আন্দোলন চালু রাখার চেষ্টা করেছিলাম এবং বাইরের সদস্যদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ এতটাই কড়াকড়ি ছিল যে আন্দোলনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অনেকটাই ব্যাহত হয়।
আমরা যখন ছয় দিন ধরে কোনো তথ্য ছাড়াই বন্দি ছিলাম, তখন পুরো পরিস্থিতি আমাদের কাছে একেবারে অন্ধকার বা শূন্য মনে হচ্ছিল। সেই সময়েও আমাদের জুনিয়ররা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং তাদের স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল— যেকোনো পরিস্থিতিতেই আন্দোলন থামানো যাবে না। আমরা তাদের কাছ থেকে পরিস্থিতির আপডেট জানার চেষ্টা করতাম।
এক দফা ঘোষণার সময় নির্ধারণে আমরা সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতাম। আমরা চেয়েছিলাম এই ঘোষণা রাজপথ থেকেই হোক, কারণ এটি কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কোনো বার্তা নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক মোড়।
এক দফা ঘোষণার মাধ্যমেই সবকিছু শেষ হয়নি, বরং এটি ছিল সরকারবিরোধী নয় দফা দাবির আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও সাংগঠনিক ফরমালিটি। তবে ৩ তারিখে এক দফা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি বা ‘গ্রাউন্ড’ তখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। প্রথম গণহত্যার খবর এবং ২১০ জন নিহতের তথ্য সামনে আসার পর ধীরে ধীরে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।
সে সময় আন্দোলন ছিল দমনপীড়নের শিকার এবং ছিন্নভিন্ন অবস্থায়। ফলে পুনঃসংগঠনের (রিগ্রুপিং) প্রয়োজন দেখা দেয়। আমরা মুক্তি পাওয়ার পর সেই পুনঃসংগঠনের সুযোগ তৈরি হয়।
২ তারিখের ‘দ্রোহযাত্রা’ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। তখন আমরা উপলব্ধি করি— এক দফা ঘোষণা দিলে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হবে। অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দুই তারিখ রাতেই অনলাইনে এক দফা ঘোষণা দেওয়া হোক। কিন্তু আমরা রাজপথ থেকেই এই ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় ছিলাম, কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিল— জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে নেতৃত্বকে মাটির কাছাকাছি থাকতে হবে।
শহীদ মিনারে গুলির ভয় ছিল বটে, কিন্তু আমরা সেটিকে একটি ‘ওয়েক-আপ কল’ হিসেবে দেখেছিলাম। এটি ছিল একটি স্পষ্ট বার্তা যে যেখানে আছো, শহীদ মিনারে চলে এসো। জনগণ নেতৃত্বকে যেখানে দেখবে, সেখান থেকেই আন্দোলন আবার গতি পাবে।
বাসস : এক দফা ঘোষণার দিন ও পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের পরিস্থিতি, কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং সরকার ও পারিবারিক পর্যায় থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমরা ৩ তারিখে এক দফা ঘোষণার জন্য মাস্ক পরে শহীদ মিনারে আসি। সেদিন আমরা সবাই মিলে এক দফা ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করি, যেখানে নাহিদ ভাই এক দফা ঘোষণা দেন। এরপর আমরা মিছিল নিয়ে শাহবাগে যাই। ওইদিন তুলনামূলকভাবে হতাহত কম ছিল, তবে এক দফার ঘোষণাটি দ্রুত ও ব্যাপকভাবে প্রচার পায়।
পরদিন, ৪ তারিখে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি একদম বদলে যায়। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ‘ডু অর ডাই’ ধরণের। মানুষ অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করে।
কিন্তু ওই দিন ছাত্রলীগ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। যদিও তারা আন্দোলন দমন করতে ব্যর্থ হয়। সন্ধ্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালায়, যার ফলে চারজন শহীদ হন। বিকেল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গুলির ঘটনা শুরু হয়, এবং রাতেই আমাদের কাছে খবর আসে— ১০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সেদিনই ঢাকায় 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমাদের মাধ্যমে জানা যায়, দুই থেকে তিন তারিখের মধ্যে তারা একটি ‘নেগোশিয়েশন কমিটি’ গঠন করে, যার দায়িত্ব ছিল আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং কনভেনশনাল কমিটির মাধ্যমে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্নরকম। আমি যখন ডিবি থেকে ছাড়া পাই, তখন আমার পরিবার আমাকে আন্দোলনে ফিরে যেতে না করার জন্য অনেকভাবে বাধা দিয়েছিল। তারা চাইতো আমি নিরাপদে থাকি। এমন পরিস্থিতিতে আমি নিজ এলাকা ছেড়ে এক পরিচিত ভাইয়ের বাসায়, মানিকনগরে চলে যাই। সেখান থেকে মাস্ক পরে শহীদ মিনারে এসে এক দফা ঘোষণায় অংশ নিই।
বাসস : এক দফা ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে আপনার কী পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা ছিল? বিশেষ করে ৪ জুলাইয়ের পরিস্থিতি, কর্মসূচি গ্রহণ ও ঘোষণার পদ্ধতি?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : আমাদের মনে হয়েছিল এক দফা ঘোষণার পর আন্দোলন হয়তো আরো ১৫ থেকে ২০ দিন চলবে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের পরিকল্পনা ছিল। পাঁচ তারিখে সবকিছু শেষ হবে এটা কেউ ভাবেনি। তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম বাস্তবতা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে এক দফা ঘোষণা করাই সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ। অনেকেই বলেছিলেন অনলাইনে ঘোষণা করা হোক, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ছিল রাজপথ থেকে ঘোষণা করাটাই মানুষের আস্থা অর্জনের পথ। শহীদ মিনারে গুলি হওয়ার ভয় ছিল, কিন্তু সেটা আমাদের জন্য ওয়েক-আপ কল ছিল। যেখানে লিডারশিপ থাকবে, সেখানে মানুষ এসে ঐক্যবদ্ধ হবে—এই ধারণায় আমরা কাজ করেছি।
চার তারিখে আমি মানিকনগরের এক পরিচিত বাসায় ছিলাম। ওই বাসাটির সামনের ব্রিজটি তখন ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের একাধিক লোক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ওরা ওই ব্রিজটি নিজেদের পয়েন্ট হিসেবে গড়ে তুলেছিল এবং প্রায় ১০০ জনের মতো লোক অস্ত্রসহ সেখানে অবস্থান করছিল। বাসা থেকে বের হওয়া, এমনকি আশেপাশে যাওয়াও অসম্ভব ছিল। আমরা সারাদিন অপেক্ষা করেছিলাম কখন কোথাও যেতে পারবো, ছাদ থেকে চেক করেছিলাম অন্য কোনো পথ আছে কিনা, কিন্তু ওরা আমাদের চিনে ফেলেছিল। তাই যেকোনো রাস্তায় আমাদের চলাফেরা বন্ধ ছিল।
নাহিদ ভাইয়ের ওইদিন শাহবাগে যাওয়ার কথা ছিল, আমরা একসঙ্গে সেখানে মিশতে চাইছিলাম, কিন্তু পারিনি। নাহিদ ভাই বললেন, তুমি যেহেতু সেখানে আছো, তুমি কর্মসূচি ঘোষণা করো। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই আগামীকাল শ্রমিক, নারী, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদেরকে নিয়ে সমাবেশ করা হবে। একটি ব্যাপক অভ্যুত্থান সফল করতে সবাইকে যুক্ত করতে হবে, এটা ছিল আমাদের বিশ্বাস। আমি চার তারিখ দুপুর দুইটায় একটা ভিডিও বার্তায় প্রাথমিকভাবে এই কর্মসূচি ঘোষণা করি।
কিন্তু পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। ঢাকার বাইরে থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন ঢাকায় আসছিল। পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ করার গুঞ্জনও ছিল, যা আমাদের দ্রুত কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছিল। সেই কারণে ভিডিও বার্তা দিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে অনেক অনিশ্চয়তা ছিল। কারো কোনো একক সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং পরস্পরের মতামত নিয়ে নেওয়া হয়। ওই সময় ফোন যোগাযোগ ছিল খুব কঠিন, অনেকের ফোন বন্ধ থাকত। যারা ফোন করত, তাদেরও অনেকবার ফোন করার পর পাওয়া যেত। এয়ারপ্লেন মোড, ভিপিএন সব ব্যবহার করতাম যাতে ট্রেস না হয়। তবে পরে আবার আলোচনা হয় এবং কর্মসূচি একদিন এগিয়ে নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে অনেকেই পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছিল। কারণ এ কর্মসূচি যদি ঢাকায় সফল না হয়, তাহলে আন্দোলন ভেস্তে যেতে পারে, যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত প্রচুর মানুষের জীবন নষ্ট করতে পারে। সেজন্য অনেক সাবধানতা ও আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বাসস : ৫ জুলাই চানখারপুলে গোলাগুলির সময় আপনার অভিজ্ঞতা, আহতদের উদ্ধারে পদক্ষেপ ও আন্দোলনের পরবর্তী পরিকল্পনায় আপনার ভূমিকা কী ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : পাঁচ তারিখ সকালে আমি মানিকনগরে ছিলাম, যেখানে আগের দিন বাসা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি কারণ সেখানে লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। পরে সিএনজি নিয়ে চানকারপুলে যাওয়ার জন্য পুরান ঢাকার ভিতর দিয়ে ঘুরে আসার চেষ্টা করলাম। পুরান ঢাকায় তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল, তাই কিছু রাস্তা দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
চানকারপুলে এসে পৌঁছালে দেখি পুলিশ, আনসার এবং স্থানীয় কিছু গ্রুপ গোলাগুলি করছে। আমি একটা বিল্ডিংয়ের উপর থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সেখানে দেখলাম অনেক মানুষ গুলির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তবে গুলি হচ্ছিল। শুনলাম দুইজন শহীদ হয়েছেন, একজন আহতকে কোলে করে নেওয়া হচ্ছে। আমরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম, পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল।
সেখানে গোলাগুলির সময় সোহাগ হোটেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ‘আনাস’ নামের এক ব্যক্তি শহীদ হন। আমরা বুঝতে পারলাম স্নাইপারও ব্যবহৃত হচ্ছে। আমার পাশের একজনের গায়ে গুলি লেগে সে সাথে সাথেই মারা যায়।
আহতদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। যাত্রাবাড়ির মিছিলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল, যারা শ্রমিকসহ আসছিল। তাদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা আহতদের ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার চেষ্টা করি। তবে সেখানে গুলি চালানো হচ্ছিল, প্রায় ২০ জন নিহত হয়। আমরা ছয়জন আহত ছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই কঠিন ছিল যে পুলিশ পিছু হটে গেলে আমরা মিছিল নিয়ে ঢাকায় ঢুকে শাহবাগে পৌঁছাই।
শাহবাগে তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা যোগাযোগ করছিলেন। আমরা শুনেছিলাম সামরিক শাসন জারি হতে পারে, যা নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগ ছিল। তাই আমি লাইভ স্ট্রিমে ঘোষণা দিয়েছি সবাই শাহবাগে এসে প্রতিবাদ করুন, আমরা সামরিক শাসন গ্রহণ করবো না। ওই সময় প্রচুর চাপ ও দমনপীড়নের মুখোমুখি থাকা সত্ত্বেও, আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক দৃঢ় সংকল্প কাজ করছিল।
বাসস : শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর আপনি প্রথম কোথায় এবং কীভাবে জানতে পারেন? সেই মুহূর্তে আপনার প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : তখন আমরা শাহবাগ থেকে একটি বিশাল মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। মিছিলটি কাওরান বাজার অতিক্রম করার পর আমার কাছে একটি ফোন আসে, সম্ভবত কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি (ডিডব্লিউ বা এএফপির কেউ)। তিনি বললেন, ‘শেখ হাসিনা তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী?’ তখন ঘড়ির কাঁটা দেড়টা। আমি হতভম্ব হয়ে যাই, বিশ্বাস হচ্ছিল না। এরপর আমি বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক ছিল দুর্বল।
খবর নিশ্চিত হওয়ার পর আমি মিছিলের মধ্যে সবাইকে জানাতে চাই, কিন্তু মাইক ছিল না, কেউ শুনছিল না, অনেকেই বিশ্বাসও করছিল না। মিছিল ঢেউয়ের মতো সংসদ ভবনের দিকে চলে যায়। আমি তখন সেখানে উপস্থিত না থাকলেও আমাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়া হয়।
ওই মুহূর্তে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। আগের রাতেই আমি ফেসবুকে পাঁচ দফার একটি রূপরেখা দিয়েছিলাম— যদি শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন, তাহলে আমাদের করণীয় কী হবে। ঘোষণা দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি, কিন্তু নির্দেশনাহীনতা ঠেকাতে আমরা একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।
বাসস : ওই পাঁচ দফা রূপরেখার পেছনের গল্প কী ছিল এবং সেটি কোথা থেকে এসেছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : ঠিক তাই। আমাদের ধারণা ছিল পরিস্থিতি হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে, এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে যেতে হতে পারে। তাই ৪ জুলাই রাতেই আমি মাহফুজ ভাইকে অনুরোধ করি— একটি পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র দরকার। তিনি বলেন, “এটা তো চার লাইনে হয় না, সময় দিতে হবে।’
পরে তিনি বললেন, আমি অন্তত রূপরেখাটা ফেসবুকে লিখে দিই— যাতে পরদিন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে মানুষ কিছু নির্দেশনা পায়। আমার লেখার দক্ষতা তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রের জন্য যথেষ্ট ছিল না, তাই আসাদ ভাই আমাকে পাঁচটি মূল পয়েন্ট ঠিক করতে সাহায্য করেন।
এই রূপরেখাটিই পরে ঘোষণার জায়গা নেয়, কিন্তু এখনো আফসোস রয়ে গেছে— পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্রটি দিতে পারিনি। যদি পারতাম, রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা আরও পরিপূর্ণ হতো।
বাসস : আন্দোলনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কোনটি আপনার কাছে?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : অনেক ঘটনা হৃদয়ে গেঁথে আছে, তবে যদি একটি বেছে নিতে হয়— তবে বলব, আবু সাঈদের শাহাদাতের মুহূর্তটি। আমরা তখন শহীদ মিনারে অবস্থান করছিলাম, হাতে লাঠি ও স্ট্যাম্প। শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ খবর এলো— আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। প্রথমে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, পরে এএফপি থেকে নিশ্চিত খবর পাই।
আমি নিজেই হ্যান্ডমাইকে সেই দুঃসংবাদ ঘোষণা করি। সেই মুহূর্তে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। চোখের সামনে সহযোদ্ধার রক্ত আর হৃদয়ে প্রতিজ্ঞা জাগে— এই রক্তের বদলা নিয়ে আমরা এই আন্দোলনের শেষ না দেখে থামব না।
বাসস: আন্দোলনের সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কর্মসূচি নির্ধারণে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া: প্রথমদিকে আমরা যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেতৃত্বে ছিলাম, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতাম। পরবর্তীতে সমন্বয় কমিটি গঠিত হলে, সেখানকার নেতৃত্ব—বিশেষ করে আমরা ছাত্রশক্তির সক্রিয় সদস্যরা— আগে নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতাম। যেমন- মাহফুজ ভাই প্রথম বলেছিলেন—‘বিডি ব্লকেড’ ভাবা যায়। পরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়— ‘বাংলা ব্লকেড’ আরও কার্যকর হবে। আমরা এটা বাস্তবায়ন করি।
কিন্তু আন্দোলনের এক পর্যায়ে—বিশেষ করে যখন ‘গুম’ শুরু হয়, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হয়, এবং রাজপথে টার্গেট কিলিং শুরু হয় তখন বড় পরিসরে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন ৩-৪ জনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হতো। তারপরেও আমরা চেষ্টা করেছি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখতে। যেমন ছাত্রদলের রাকিব ভাই, ছাত্রশিবিরের সাদিক ভাই, বাম ধারার নেতৃবৃন্দ— তাদের সাথে যোগাযোগ করে কো-অর্ডিনেশন করেছি। শহিদুল্লাহ হলে যখন হামলা হয়, তখন ছাত্রশিবির, ছাত্রদল এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মীদের নিয়ে আমরা রিগ্রুপ করে ক্যাম্পাসে ঢুকি। প্রতিরোধের মুহূর্তগুলোতে এই সংহতি কার্যত প্রাণভোমরা হয়ে ওঠে।
বাসস : আন্দোলনের সময় আপনার পরিবার কতটা ঝুঁকির মুখে পড়েছিল এবং আপনি কীভাবে সেই সময়টি সামলিয়েছেন?
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : যখন আমি প্রথম ‘গুম’-এর শিকার হই, তখন আমার বাবা-মা হাসপাতালে ও মর্গে লাশ খুঁজছিলেন। খবর ছড়িয়েছিল আমি নিখোঁজ বা শহীদ হয়েছি। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে তাদের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য পৌঁছায়নি। তারা শুধু হাসপাতালে নয়, ডিআরইউ’তে প্রেস কনফারেন্সেও গিয়েছিলেন। ছয়-সাত বছরের আন্দোলনজীবনে জেল, হয়রানি, মামলা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে পরিবারকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা প্রায়ই আমার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিতেন। বাবা-মা কখনো চাননি আমি এমন অনিশ্চয়তায় থাকি, তবে আমি জানি তারা ভেতরে ভেতরে গর্ব করতেন যে তাদের সন্তান ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
বাসস : নানা ব্যস্ততার মধ্যে সময় দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।