বাসস
  ০৭ জুন ২০২৫, ১৩:১০

মেরলুজার খোঁজে : প্রিয় মাছ বাঁচাতে চিলির লড়াই

ঢাকা, ৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে যাত্রা শুরুর আগে বিধাতার কৃপা প্রার্থনা করেন চিলির জেলে রোদ্রিগো গায়ার্দো। কারণ, তিনি একসময় সহজলভ্য হলেও এখন ক্রমশ বিলুপ্তির পথে চিলির মানুষের প্রিয় মাছ— বিরল মেরলুজা ওরফে হেক ধরতে যাচ্ছেন।

তীব্র বাতাসে সমুদ্র দুলছে। বালপারাইসো বন্দর থেকে সাত নটিক্যাল মাইল (প্রায় ১৩ কিলোমিটার) দূরে গভীর পানিতে পৌঁছাতে হয় তাকে। এক সময় এসব জায়গায় ভরে থাকত চিলির মানুষের প্রিয় এই মাছ। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করে যখন গায়ার্দো তার সার্ডিনে সাজানো বড়শিযুক্ত লম্বা রশি টেনে আনেন, তখন দেখা যায় মাত্র একটি হেক ধরা পড়েছে।

৪৬ বছর বয়সী গায়ার্দো হতাশ হয়ে বলেন, 'আগে ট্রলারের স্টোরেজভর্তি মাছ থাকত।' দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের হেক চিলির প্রায় ৪,০০০ ক্ষুদ্র জেলের জীবিকার উৎস। ৬,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি উপকূলরেখা-সমৃদ্ধ দেশটির জনগণের মাছের তালিকায় হেক বা ‘মেরলুজা’ রয়েছে শীর্ষে।

তবে সস্তা ‘কড’-এর বিকল্প এই মাছের প্রতি ভালবাসাই এখন এর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিলির মধ্যাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাছধরা এলাকায় ক্রমেই বাড়ছে ফাঁকা নৌকার সংখ্যা। কারণ অতিরিক্ত মাছধরা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একত্রে হেকের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।

চিলির ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (আইএফওপি)'র তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে হেকের পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমে গেছে। গায়ার্দোর মতে, এর জন্য দায়ী সেই সব নিয়ম-কানুন যা বাণিজ্যিক ট্রলারদেরই উপকারে এসেছে। তারা গভীর পানিতে বিশাল জাল ফেলে প্রচুর পরিমাণে মাছ তুলে নেয়, যার ফলে সমুদ্র মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, বাণিজ্যিক মৎস্য সংস্থাগুলোর দাবি, ক্ষুদ্র জেলেদের অবৈধ মাছধরাই আসল সমস্যা।

আইন পর্যাপ্ত নয়

চিলি বহু বছর ধরেই অতিরিক্ত মাছধরার বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ২০১০-এর দশকের শুরুতে হেক, জ্যাক ম্যাকেরেল ও জুম্বো স্কুইডের মতো বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়ায় সরকার বার্ষিক বায়োম্যাসের ভিত্তিতে কোটা নির্ধারণ করে।

এছাড়া দেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি জলসীমা ‘মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে মাছ ধরা সীমিত। চিলি জাতিসংঘের ‘হাই সিজ ট্রিটি’-তেও স্বাক্ষর করেছে, যা সমুদ্রজীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক।

দশ বছর পর দেখা যায়, সার্ডিন, কটলফিশ ও হর্স ম্যাকেরেলের মতো কিছু প্রজাতির সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু হেকের বেলায় পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক।

আইএফওপি'র ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় হেকের বায়োম্যাসের পরিমাণ আরও ১৭ শতাংশ কমেছে।

সিন্ধুতেবিন্দু' 

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের চিলি শাখার সংরক্ষণ পরিচালক রোদ্রিগো কাতালান হেকের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যার জন্য ‘অবৈধ মাছধরা, অতিরিক্ত শোষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন’—এই তিন কারণকে দায়ী করেন।

২০২৩ সালে চিলির কর্তৃপক্ষ ৫৮ টন অবৈধ হেক জব্দ করে, যা অ্যাঙ্কোভির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে কর্তৃপক্ষের ধারণা, এটি কেবল 'সিন্ধুতে বিন্দু'। কারণ হেক সাধারণত তীরে খুব কাছে ধরা পড়ে, আর তাড়াতাড়ি জাল টেনে নেওয়ার ফলে এটি নজরে পড়ে না।

জাতীয় মৎস্য বিভাগের মতে, এসব মাছ ছোট ছোট অংশে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হওয়ায় তা চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্র ও বসবাসের জায়গা দুটোতেই প্রভাব ফেলছে। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এলিসিয়া গায়ার্দো বলেন, 'সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হেক এখন ঠান্ডা স্রোতের খোঁজে আরও দক্ষিণে চলে যাচ্ছে এবং প্রজনন হারও কমে যাচ্ছে।'

অনেক জাল, কম মাছ 

বছরের পর বছর ধরে হেকের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা কমে এসেছে। ২০০১ সালে তা ছিল ১১৮,০০০ টন, এখন তা মাত্র ৩৫,০০০ টন। এতে চিলির মৎস্যজীবী সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

সমুদ্র সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থা ওশেনার পরিচালক লিজবেথ ফান দার মেয়ার বলেন, 'এত জেলের জন্য পর্যাপ্ত মাছ নেই।' চলতি বছরের মার্চে, ভালপারাইসোর ক্ষুদ্র জেলেরা তিনদিন ধরে পুলিশদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। তাদের অভিযোগ ছিল, হেকসহ কিছু প্রজাতির কোটা বাড়াতে একটি বিলের অনুমোদনে বিলম্ব হচ্ছে।

চিলির বৃহত্তম বাণিজ্যিক মাছ সংস্থা প্যাসিফিকব্লু হুমকি দেয়, যদি তাদের কোটা কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নেবে—যার ফলে ৩,২০০ জন চাকরি হারাতে পারেন। তবে পরে তারা এই হুমকি প্রত্যাহার করে নেয়।

উল্লেখ্য, হেকের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জেলেদের কোটা ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করার যে বিল আনা হয়েছিল, তা এ সপ্তাহেই সিনেটে অনুমোদন পেয়েছে।