বাসস
  ০৭ জুন ২০২৫, ১২:৩৬

ট্রাম্পের দমননীতির অভিঘাতে বিধ্বস্ত এক ভেনিজুয়েলান পরিবার

ঢাকা, ৭ জুন, ২০২৫ (বাসস) : মার্সেডেস ইয়ামার্তের তিন ছেলেই একসময় ভেনিজুয়েলা ছেড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে একটি উন্নত জীবনের খোঁজে। এখন, একজন এল সালভাদরের এক কারাগারে বন্দি, আরেকজন মেক্সিকোতে ‘স্বেচ্ছায় নির্বাসনে’, এবং তৃতীয়জন যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে দিন কাটান— যে কোনো মুহূর্তে দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ দরজা ভেঙে ঢুকে পড়বে এমন আতঙ্ক তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে ফেরে।

ভেনিজুয়েলার মারাকাইবো শহরের এক দরিদ্র পাড়ায় টিনের চালের ঘরে বসে ৪৬ বছর বয়সী মার্সেডেস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন দমননীতির ফলে তার পরিবার খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে এ নিয়ে যখন ভাবেন, তখন তার চোখের কোণা জলে ছলছল করে।

ভেনিজুয়েলায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতায় তার ছেলেরা পিছিয়ে পড়েছিল—যা ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ লাখ মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। কিন্তু দেশ ছেড়ে নতুন জীবন খুঁজতে গিয়ে আবারও তারা রাজনীতির শিকার হলো—এবার এক এমন দেশের, যার নেতৃত্বে আছেন এমন এক প্রেসিডেন্ট, যিনি তার দরজা বন্ধ করে দিতে বদ্ধপরিকর; অথচ সেই দেশ একসময় অভিবাসীদের স্বাগত জানাতেই গর্ববোধ করত।

বড় ছেলে মেরভিন (৩০) দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন, স্ত্রী ও ছয় বছরের মেয়েকে রোজগার পাঠাতেন। টেক্সাসে নির্মাণসাইটে এবং একটি টর্টিলা কারখানায় কাজ করতেন।

১৩ মার্চ, মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেপ্তার করে সরাসরি নির্বাসন দেয় এল সালভাদরের একটি ‘মেগা জেল’-এ, যেখানে তিনি এখনও নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দি রয়েছেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, মেরভিন ও আরও ২৫১ ব্যক্তিকে ভেনিজুয়েলার অপরাধী গ্যাং ‘ত্রেন দে আরাগুয়া’র সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—একটি গ্যাং যাকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে।

এর প্রমাণ হিসেবে ওদের শরীরের উল্কিচিত্র দেখানো হচ্ছে—যা অনেক বিশেষজ্ঞই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কারণ, অন্যান্য লাতিন আমেরিকান গ্যাংয়ের মতো এই গ্যাংয়ের সদস্যরা সাধারণত গ্যাং সম্পর্কিত উল্কি ব্যবহার করেন না।

মেরভিনের শরীরে তার মা ও মেয়ের নাম, 'মায়ের মতো দৃঢ়' কথাটি স্প্যানিশে, এবং '৯৯' সংখ্যাটি লেখা রয়েছে—যা তার পরিবারের মতে তার ফুটবল জার্সির নম্বর, কোনো গ্যাং চিহ্ন নয়।

উত্তরের যাত্রা

২০২৩ সালে মেরভিন তার ছোট ভাই জনফারসনের (২১) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। দুজনেরই লক্ষ্য ছিল কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠানো।

তারা কলোম্বিয়া ও পানামার মাঝে বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক মাইগ্রেশন রুট হিসেবে পরিচিত একটি ভয়ংকর বনাঞ্চল, দারিয়েন গ্যাপ হেঁটে পাড়ি দিয়েছিলেন।

এরপর তারা মেক্সিকোর মধ্য দিয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে যান। এক বছর পর তাদের বোন ফ্রানসিস (১৯) রওনা হলেও মাঝপথ থেকে ফিরে যান। তবে ভাই জুয়ান (২৮) যাত্রা চালিয়ে যান।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে তারা সীমান্ত কর্মকর্তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। জানানো হয়, বিচারক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত তারা আইনিভাবে দেশটিতে থাকতে পারবেন।

কিন্তু এরপর মার্কিন ভোটে পরিবর্তন আসে, এবং প্রশাসন বদলায়। ১৩ মার্চ ভোরবেলায় টেক্সাসের আরভিং শহরের এক অ্যাপার্টমেন্টে, যেখানে তারা বন্ধুদের সঙ্গে থাকতেন, সেখানে হানা দেয় অভিবাসন কর্মকর্তারা।

তাদের একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। মেরভিনকে দেখে তারা বলেন: 'তোমাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে তদন্তের জন্য,' জুয়ান স্মৃতিচারণ করেন।

যখন তারা জানায় মেরভিনের জন্যও একটি পরোয়ানা রয়েছে, তখন তিনি তার আশ্রয়ের কাগজ দেখাতে চান। 'কিন্তু তখনই ওকে হাতকড়া পরানো হয়ে গেছে,' বলেন জুয়ান।

মেরভিনকে এক ডিটেনশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়, সেখান থেকে তিনি জনফারসনকে ফোন করে জানান যে তাকে কোথাও বহিষ্কার করা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক কোথায় জানেন না।

তিন দিন পর, জনফারসন টিভির পর্দায় তার ভাইকে দেখতে পান—ডজনখানেক চুল কাটা, হাতকড়া পরা পুরুষদের ভিড়ে, যারা এল সালভাদরের রাষ্ট্রপতি নায়িব বুকেলের নির্মিত কারাগার ‘সিসট’-এ পাঠানো হচ্ছে।

ভাইকে কারাগারের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং মাকে ফোন করেন।

মার্সেডেসও সেই ছবি দেখেছিলেন। 'আমার ছেলে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল, চোখ তুলে যেন বলছে: ‘আমি কোথায়? আমি কী করেছি যে এখানে এলাম?’ বলেন তিনি। 'আমি কখনও আমার ছেলেকে এত ভয় পেতে দেখিনি।'

দক্ষিণের যাত্রা

ভাইয়ের গ্রেফতারের পর জনফারসন দুঃস্বপ্নে কাতরাতে থাকেন। ভয় এতটাই বেড়ে যায় যে তিনি মেক্সিকো হয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন—যা অনেকেই কৌশলী ভাষায় বলেন 'স্বেচ্ছা নির্বাসন'।

সেখানে তিনি এক মাস অপেক্ষা করে ভেনেজুয়েলার একটি ‘মানবিক ফ্লাইট’-এ উঠতে সক্ষম হন। বিমানবন্দরের পথে বাসে বসে তিনি এএফপিকে বলেন, 'এটা ছিল এক দুঃস্বপ্ন।'

অন্যদিকে, জুয়ান এখনও যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তিনি গোপনে বাস করেন, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন এবং ধরা না পড়ার জন্য প্রায়ই জায়গা বদল করেন।

'আমি সবসময় লুকিয়ে থাকি। দোকানে গেলেও চারপাশে তাকিয়ে থাকি, যেন কেউ আমাকে অনুসরণ করছে,' বলেন তিনি। নিজের মুখ ও অবস্থান প্রকাশে রাজি হননি তিনি।

একমাত্র উপার্জনক্ষম ভাই হিসেবে এখন তার ওপর নির্ভর করে পরিবারের রোজগার। তার স্ত্রী ও সাত বছরের সন্তানও আছেন।

তবে ভাই মেরভিনের বন্দিত্বের কথা মনে পড়লে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। 'আমার মা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। অনেক দিন ঘুমাতে পারেন না,' বলেন তিনি। 'আমার ভাবি প্রতিদিন কাঁদেন। তিনি ভীষণ কষ্টে আছেন।'

বাড়ির পথে

জনফারসন এখন মারাকাইবোতে ফিরে এসেছেন। তার জন্য ঘর সাজানো হয়েছিল নীল, হলুদ ও লাল বেলুনে—ভেনিজুয়েলার জাতীয় পতাকার রঙে।

তার মা মার্সেডেস কৃতজ্ঞ হলেও মন এখনও ভারী।

'আমার খুশি হওয়া উচিত, তাও পারছি না। আমার আরেক ছেলে এল সালভাদরে, কী অবস্থায় আছে জানি না,' বলেন তিনি।

তবে যখন তিনি তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন, মুহূর্তের জন্য তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন তাকে আর কখনও ছেড়ে দিতে চান না।

'আমি কখনও ভাবিনি, ছেলেরা দূরে থাকলে এতটা কষ্ট পাব,' বলেন মার্সেডেস। 'আমি জানতাম না, এমন যন্ত্রণাও অনুভব করা যায়।'

এ মুহূর্তে তিন ভাই একত্রে আছেন কেবল একটি স্ক্রিনশটে—গত বড়দিনের ভিডিও কলে তোলা ছবি, যা মার্সেডেস তার মোবাইলে রেখে দিয়েছেন।