বাসস
  ০৬ জুন ২০২৫, ২০:১৪

জিহাদি থেকে রাষ্ট্রনায়ক : ছয় মাসে বিস্ময়কর

\ রূপান্তর সিরিয়ার আহমেদ আল-শারা'র \

ঢাকা, ৬ জুন, ২০২৫ (বাসস) : মাত্র ছয় মাসেই এক সময়ের পলাতক জিহাদি নেতা থেকে বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কূটনীতির হাত মেলানো রাষ্ট্রনায়কে রূপান্তরের বিস্ময়কর অভিযাত্রা সম্পন্ন করেছেন সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা।

১৯৮২ সালে জন্ম নেওয়া শারা ‘আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি’ ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর ইসলামপন্থী জোটের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করে দামেস্ক দখলের পর শারা নিজের চেহারা-চরিত্র ও পরিচয়ে আমূল বদল ঘটিয়েছেন।

ঘন দাড়ি কেটে-ছেঁটে, যুদ্ধপোশাক ছেড়ে এখন তিনি পরিপাটি স্যুট-টাই পরা এক রাষ্ট্রপ্রধান। জানুয়ারি মাসে তাকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়, যার অধীনে দেশটি পাঁচ বছরের একটি সংবিধান-সংশোধনী রূপান্তর পর্যায়ে প্রবেশ করে।

সাবেক প্রতিরূপ—যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আটক অবস্থায় ইরাক যুদ্ধকালীন প্রকাশিত একটি মাত্র ছবিতে সীমাবদ্ধ থাকা রহস্যময় চেহারাটি এখন বদলে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, শারা নিজ গাড়ি চালাচ্ছেন, কর্মচারী ক্যান্টিনে খাবার খাচ্ছেন বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টাই পরে বাস্কেটবল খেলছেন।

'আমি মনে করি, তিনি নিজের রূপান্তরে সফল হয়েছেন,' বলেন ইসলামপন্থী আন্দোলন নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংকট গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষক জেরোম দ্রেভোঁ।

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে শারাআ ইউরোপ সফর করেছেন, এবং এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো ইসলামপন্থী-বিরোধী দেশগুলোর কাছেও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।

‘বিকল্প নেই’

গত মাসে ইউরোপ সফরের অংশ হিসেবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে প্যারিসে সাক্ষাৎ করেন শারাআ। তার এক সপ্তাহ পরই সৌদি আরব সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে করমর্দন করেন, যেখানে ট্রাম্প ঘোষণা দেন—ওয়াশিংটন সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে।

ট্রাম্প তার সম্পর্কে বলেন, 'তরুণ, সুদর্শন এক ব্যক্তি। কঠিন অতীত—খুবই কঠিন। লড়াকু।'

যদিও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল রয়েছে শারা'র ওপর, তবে প্রতিটি সফরের জন্য আলাদাভাবে ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

দ্রেভোঁ বলেন, 'বিদেশি শক্তিগুলো একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের ভেতরে এখনও নিরাপত্তা সমস্যা রয়েছে, টানাপোড়েন চলছে, তবে এই মুহূর্তে শারা'র বিকল্প নেই বলে প্রায় সবাই তাকেস্বীকৃতি দিচ্ছে।'

শারা এখন দামেস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বসবাস করছেন—যেখানে একসময় বাস করতেন আসাদ। গত ঈদ উপলক্ষে তিনি ও তার স্ত্রী লতিফা আল-দরুবি সেখানে সিরিয়ার এতিম শিশুদের স্বাগত জানান।

বিদ্রোহ থেকে প্রশাসন

শারা তার অতীতকে অস্বীকার না করলেও, সেটিকে কৌশলে রাজনৈতিক মূলধনে রূপান্তর করছেন। এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি বলেন, 'আমরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছি—প্রাসাদে বিলাসিতায় অভ্যস্ত নই। মাত্র দুই বছর আগেও আমার নিজস্ব অফিস ছিল না। গাড়ির ভেতরে, রাস্তায়, কিংবা জলপাই গাছের নিচে বৈঠক করতাম।'

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরকারিভাবে সব সশস্ত্র গোষ্ঠী বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়—তাদের মধ্যে ছিল শারাআর নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), যারা আসাদবিরোধী বিজয়ে নেতৃত্ব দেয়।

এইচটিএস আগে ছিল আল-কায়েদার শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট, যেটি ২০১৬ সালে মূল সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।

‘বাস্তববাদী কট্টরপন্থী’

রাজনৈতিক ইসলাম বিশ্লেষক থমাস পিয়েরে শারাআকে বলেন, 'একজন বাস্তববাদী কট্টরপন্থী'।

সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া শারা সিরিয়ার ধনী পরিবারের সন্তান। দামেস্কের অভিজাত মাজ্জে এলাকায় বেড়ে ওঠেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করলেও পরে গোপন ইসলামি গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের পর তিনি আল-কায়েদায় যোগ দিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নেন, এবং পাঁচ বছর ধরে আটক ছিলেন।

২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেন।

২০১৭ সালে শারা উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার ইসলামপন্থী দলগুলোকে একীভূত করে এইচটিএস গঠন করেন, যা পরে ইদলিব প্রদেশে প্রশাসন চালাতে শুরু করে। এই সময় তিনি বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগেও অভিযুক্ত হন।

ভবিষ্যৎ কী?

যদিও শারা এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দৃশ্যমান এবং কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য হচ্ছেন, তবে তাঁর অতীত এবং বর্তমান শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে সিরিয়ার জন্য তাঁর নেতৃত্ব একটি ‘বাস্তবিক প্রয়োজন’—তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি কতটা টেকসই হবে, তা নির্ভর করবে দেশীয় সংস্কার, আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর।