শিরোনাম
ঢাকা, ৫ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ঈজিয়ান সাগরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ক্ষুদ্র প্রবালসমৃদ্ধ গ্রিক দ্বীপপুঞ্জ ফোরনুইয়ের জেলেরা ট্রলার নিষেধাজ্ঞার ফলে আবারও সমুদ্রের প্রাণ ফিরে আসার আশায় বুক বাঁধছেন। তবে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিল্পজেলেরা।
গ্রিসের ফোরনুই থেকে এএফপি জানায়, ৭৬ বছর বয়সী ম্যানোলিস মাইটিকাসের কাঠের মাছধরা নৌকাটি ভোরের প্রথম আলোয় যখন দ্বীপে ফিরে আসে, তখন তার জালে তেমন মাছ ধরা পড়েনি। তবু দ্বীপবাসীরা সেই স্বল্প পরিমাণ তাজা মাছ পেতে ছুটে আসেন, গত কয়েক বছরে এখানে এটি ছিল একবোরেই দুর্লভ।
‘আজ আমরা দু’জন সমুদ্রে গিয়েছিলাম, ‘ভাগ্যক্রমে অল্প মাছ ধরা পড়েছে,’ বলেন মাইটিকাস।
‘কাল ৩০ ইউরো রোজগার হয়েছিল, তার আগের দিন কিছুই পাইনি। কখনো কখনো তো খাওয়ার মতোও রোজগার হয় না।’
তবে গত মাসে গ্রিক সরকার এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় তলদেশঘেঁষা ট্রলার চলাচল নিষিদ্ধ করেছে, সম্প্রতি আবিষ্কৃত দুর্লভ প্রবাল প্রচীর রক্ষায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সরকার ঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে জাতীয় সামুদ্রিক উদ্যানে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সব সুরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকায় ট্রলার নিষিদ্ধ করা হবে, এই পদক্ষেপ নেওয়া ইউরোপে প্রথম।
সাধারণত বিশ্বজুড়েই সুরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকাগুলোতেও মাছ ধরা হয়, এমনকি ট্রলার দিয়েও। এসব ট্রলার বিশাল নেট টেনে সাগরতল ঘেঁষে মাছ ধরে, যা সমুদ্রতল ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক।
নিষেধাজ্ঞার খবর পেয়ে মাইটিকাস বলেন, ‘অবশেষে! ওরা সাগরটাকে তছনছ করে দিয়েছে, তলদেশ চষে সবকিছু ধ্বংস করেছে।’
ফোরনুইয়ের আরেক জেলে, ৫৮ বছর বয়সী ভ্যাঙ্গেলিস মারকাকিস বলেন, ‘ট্রলারগুলো যেন বুলডোজার।’ ‘তাদের ঠেকাতে পারলেই সমুদ্রটা আবার প্রাণ ফিরে পাবে,’ আশাবাদ ব্যক্ত করেন মাইটিকাস।
কনজারভেশন গ্রুপ আর্কিপেলাগোস ও আন্ডার দ্য পোলের নেতৃত্বে ইউরোপীয় গবেষকদের সঙ্গে যৌথ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফোরনুইয়ের আশপাশে ৬০ থেকে ১৫০ মিটার গভীরে প্রায় ৩০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী টিকে আছে।
‘আমরা যা আবিষ্কার করেছি, তা কল্পনারও বাইরে, হাজার বছরের পুরোনো অক্ষত প্রবাল রিফ,’ বলেন আর্কিপেলাগোসের বৈজ্ঞানিক পরিচালক আনাস্তাসিয়া মিলিউ।
প্রবালগুলোতে রয়েছে উজ্জ্বল লাল গোরগোনিয়ান ও কালো প্রবাল। উচ্চ ঘনত্বে এসব জীব ‘জলজ অরণ্য’ সৃষ্টি করে বলে জানান সিএনআরএসের গবেষক লরেঞ্জো ব্রামান্তি।
তবে এসব বাস্তুতন্ত্র অত্যন্ত সংবেদনশীল।
‘একবার মাত্র ট্রলার চালালেই তা সম্পূর্ণ ধ্বংস হতে পারে,’ সতর্ক করেন ঈজিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টেলিওস কাটসানেভাকিস।
‘ধ্বংস হলে এদের পুনরুদ্ধারে দশক নয়, শতাব্দীও লেগে যেতে পারে,’ বলেন ব্রামান্তি।
তিনি বলেন, ‘জলজ অরণ্য কেটে ফেলাও ঠিক স্থলভাগের বন উজাড় করার মতোই এক পরিবেশগত বিপর্যয়।’
ব্রামান্তি আশা করেন, ফোরনুইয়ে ট্রলার নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গ্রিস ভূমধ্যসাগরীয় অন্য দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
‘এই বাস্তুতন্ত্রগুলো এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে খানিকটা রক্ষা পেয়েছে, কারণ এগুলো ৭০ মিটারের বেশি গভীরে অবস্থিত। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে,’ বলেন তিনি।
তবে নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন শিল্পজেলেরা। গ্রিসে বর্তমানে প্রায় ২২০টি ট্রলার সক্রিয়।
‘আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি,‘ অভিযোগ করেন উত্তর গ্রিসের নিয়ামিখানিওনার ট্রলার সমবায়ের প্রধান কস্তাস দাউলতজিস।
তিনি দাবি করেন, ‘এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে, যাদের গবেষণার যথাযথ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’
তিনি বলেন, ট্রলারগুলো এমনিতেই প্রবাল এলাকাগুলো এড়িয়ে চলে, কারণ সেখানে তাদের যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে, স্থানীয় জেলেরা পাল্টা দাবি করছেন, ট্রলারগুলো তাদের এলাকায় নিয়মিতই মাছ ধরে, এমনকি ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ রেখে মাছ ধরে যাতে কেউ ধরতে না পারে।
ট্রলারবিরোধী চাপ বিশ্বজুড়েই বাড়ছে। আগামী সপ্তাহে ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনেও এটি আলোচনার অন্যতম বিষয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে দাউলতজিস শঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘আমাদের মাছ ধরার জায়গা দিন দিন কমছে। আমাদের জীবিকা হুমকির মুখে। আর এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপরই পড়বে, মাছের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে।’