শিরোনাম
ঢাকা, ৫ জুন, ২০২৫ (বাসস) : প্যারিস শহরের বাইরে অবস্থিত ফ্রান্সের পারমাণবিক শক্তি কমিশনের কার্বন ডেটিং ল্যাবরেটরিতে একটি বিশাল পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে গবেষক লরাঁ বেক এএফপিকে বলেন, 'এটি যেন সময়ের তীর উল্টো ঘুরিয়ে সত্যকে সামনে নিয়ে আসে।'
এই ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত পদ্ধতির নাম কার্বন ডেটিং, যা প্রত্নতত্ত্বের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এই বিশাল অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬০ সালে এর আবিষ্কারক উইলার্ড লিবিকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
কীভাবে কাজ করে কার্বন ডেটিং?
কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে প্রথমে প্রতিটি নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় যে, তাতে কোনো দূষণ নেই। বেক জানান, 'সাধারণত এসব দূষণ হয় প্রাথমিক অনুসন্ধানকারীর সোয়েটার বা জামার তন্তু।'
এরপর নমুনাটি অ্যাসিডে পরিষ্কার করা হয় এবং ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১,৪৭২ ফারেনহাইট) পর্যন্ত গরম করে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করা হয়। এই গ্যাস পরে গ্রাফাইটে রূপান্তরিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্যাপসুলে ভরা হয়।
পরে এই ক্যাপসুলগুলো পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটরে প্রবেশ করানো হয়, যা নমুনার কার্বন আইসোটোপগুলো আলাদা করে। আইসোটোপ হলো একই রাসায়নিক মৌলিক উপাদানের ভিন্ন সংস্করণ, যাদের নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা হয়।
কিছু আইসোটোপ স্থিতিশীল—যেমন কার্বন-১২। আর কিছু রেডিওঅ্যাকটিভ—যেমন কার্বন-১৪, যা সময়ের সঙ্গে ক্ষয় হতে থাকে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে কসমিক রে ও সূর্য বিকিরণ নাইট্রোজেনকে আঘাত করার ফলে কার্বন-১৪ উৎপন্ন হয়। এই কার্বন-১৪ অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে, যা উদ্ভিদ শোষণ করে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সেই উদ্ভিদ খেয়ে এই কার্বন-১৪ নিজেদের দেহে ধারণ করে।
জীবের যতক্ষণ জীবন থাকে, ততক্ষণ সে কার্বন-১৪ ধারণ করে। আর মৃত্যুর পর এই কার্বন ক্ষয় হতে থাকে। কার্বন-১৪-এর অর্ধ-জীবনকাল ৫,৭৩০ বছর, অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে এর অর্ধেক ক্ষয় হয়। ৫০,০০০ বছর পর এটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ক্ষয় হয়ে যায়। ফলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতি এই সময়সীমার মধ্যে প্রায় নির্ভুলভাবে বয়স নির্ধারণ করতে সক্ষম।
পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটর যখন নমুনার কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪ আলাদা করে, তখন তাদের অনুপাত দেখে গবেষকরা তার আনুমানিক বয়স নির্ধারণ করতে পারেন।
তবে বেক জানান, পৃথিবীর ওপর কসমিক রেডিয়েশনের মাত্রা এবং আমাদের চারপাশের চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি সময়ের সঙ্গে বদলায়। তাই গবেষকদের অন্য যেসব নমুনার বয়স নির্দিষ্টভাবে জানা আছে, তাদের ভিত্তিতে অনুমান করতে হয়।
এই পদ্ধতিতে এমনকি একটি চিত্রকর্ম জাল বা নকল কি না, তাও জানা যায়—যেমন ২০১৪ সালে ইতালির পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানীরা পেগি গুগেনহেইম সংগ্রহশালার ফরাসি শিল্পী ফার্নান্দ লেজের একটি চিত্রকর্মের ক্যানভাসের ওপর রেডিওকার্বন ডেটিং প্রয়োগ করে দেখান যে, ক্যানভাসটি ১৯৫৯ সালের পর তৈরি, অথচ শিল্পী ফার্নান্দ লেজে ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে চিত্রকর্মটি নকল।
এছাড়া, সমুদ্রের গভীর তলদেশের প্ল্যাঙ্কটনের কঙ্কাল বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর আবহাওয়ার পরিবর্তনও বোঝা যায়।
নটর ডেমের গোপন কথা
কার্বন ডেটিং সাধারণত হাড়, কাঠ ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। তবে ফরাসি এই ল্যাব এমন কৌশল উদ্ভাবন করেছে যা জীবিত বস্তু থেকে না পাওয়া উপাদান দিয়েও তার সময় নির্ধারণ করতে পারে।
যেমন, তারা লোহার আকরিক কয়লা দিয়ে গলানোর সময় যে কার্বন ধরা পড়ে, সেটি ব্যবহার করে লোহার বয়স বের করতে পারেন।
২০১৯ সালে প্যারিসের বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথেড্রাল প্রায় পুড়ে যাওয়ার পর গবেষকরা দেখান, এর লোহার বড় বড় স্ট্যাপল বা ক্লিপ সেই প্রাচীন নির্মাণকালেই তৈরি হয়েছিল—কোনো পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণের কাজ হিসেবে যোগ করা হয়নি—যেমনটা আগে মনে করা হতো।
তারা লেড হোয়াইট নামে এক রঞ্জক পদার্থও বিশ্লেষণ করেন, যেটি চতুর্থ খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দী থেকে ভবনে ও চিত্রকর্মে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এই রঞ্জক তৈরি করতে, বেক বলেন, 'সীসা, ভিনেগার ও ঘোড়ার গোবর দিয়ে ক্ষয় করানো হতো। এই প্রক্রিয়ায় ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়।'
তিনি প্রত্নতত্ত্ববিদদের সবসময় বলেন, 'ক্ষয় চিহ্ন পরিষ্কার কোরো না, সেগুলোও অতীতের গল্প বলে!' একটি মধ্যযুগীয় অ্যাবের সমাধির বয়স বের করার জন্যও এমন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে কেবল সীসার ছোট ছোট বোতল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
সমাধিতে থাকা দেহগুলো পচে গিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়েছিল, যা ওই বোতলগুলোতে ক্ষয় সৃষ্টি করে। আর সেটিই বিজ্ঞানীদের জন্য হয়ে ওঠে বয়স নির্ধারণের সূত্র।
'এই ক্ষয়ই ছিল ওই সন্ন্যাসীদের আত্মার একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতি,' ভাবগম্ভীর স্বরে বলেন বেক।