বাসস
  ০৪ জুন ২০২৫, ১৫:১৩

‘সময়ে হিমায়িত’ প্রবাল হতে পারে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ বাঁচানোর শেষ আশ্রয়

ঢাকা, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : সিডনির তারোঙ্গা চিড়িয়াখানার একটি নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার কক্ষে সারি সারি তরল নাইট্রোজেনভর্তি ট্যাংক—এর ভেতর নিঃশব্দে ঘুমিয়ে রয়েছে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবাল। এ যেন সময়ের কাছে হিমায়িত হয়ে থাকা জীবন্ত জীববৈচিত্রের এক জাহাজ।

সিডনি থেকে এএফপি জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে থাকা প্রবালপ্রাচীর রক্ষায় এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় হিমায়িত প্রবাল ভাণ্ডার। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, যদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে প্রবালপ্রাচীর হতে পারে পৃথিবীর প্রথম বিলুপ্তপ্রায় পরিবেশ ব্যবস্থাগুলোর একটি।

গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের শত শত গুরুত্বপূর্ণ প্রবাল প্রজাতির ট্রিলিয়ন সংখ্যক কোষ—প্রতি বছর প্রাকৃতিক প্রজননের মৌসুমে সংগৃহীত—বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাল পুনর্জন্মের এক দুর্লভ সম্ভাবনা তৈরি করছে।

'মূলত, তাদের জৈবিক ঘড়িতে বিরতি টানা হয়েছে,' বলেন তারোঙ্গা কনজারভেশন সোসাইটি অস্ট্রেলিয়ার সংরক্ষণ বিজ্ঞান বিভাগের ব্যবস্থাপক জাস্টিন ও’ব্রায়েন।

তিনি বলেন, 'আশা করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা প্রবালের এই অপূর্ব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে সক্ষম হবো।'

২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রকল্পে, তারোঙ্গার ক্রায়োডাইভার্সিটি ব্যাংক প্রতিবছর প্রবালের প্রজননকালীন সময়ে রিফে গিয়ে ডিম ও শুক্রাণু সংগ্রহ করে।

শুক্রাণু সংগ্রহের পর তা ক্রায়োপ্রটেকট্যান্ট নামের রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে হিমায়িত করা হয়। এই পদার্থ কোষের ভেতরকার পানি সরিয়ে ফেলে এবং কোষ গঠনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

বর্তমান প্রযুক্তিতে ডিমে থাকা অতিরিক্ত পানি ও চর্বি হিমায়নের পথে বাধা হওয়ায় তা সংরক্ষণ সম্ভব নয়। তবে গবেষণার জন্য অন্যান্য কোষও সংগৃহীত হয়।

সংগৃহীত নমুনা তরল নাইট্রোজেনে -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা হয়। কঠোর নজরদারিতে তাপমাত্রা অপরিবর্তিত রাখা হয়।

ও’ব্রায়েন বলেন, 'আমরা এগুলো অনির্দিষ্টকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারি।'

'আপনি ইচ্ছা করলেই কয়েক বছর পর, কয়েক দশক পর, এমনকি শত শত বছর পরও এগুলো গলিয়ে ব্যবহার করতে পারবেন। এবং এগুলো সেই সময়ের মতোই উর্বর থাকবে।'

প্রবাল-মৃত্যুর সঙ্কেত

এই ব্যাংকে বর্তমানে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে থাকা প্রায় ৪০০টি কড়াজাতীয় প্রবাল প্রজাতির মধ্যে ৩৪টি সংরক্ষিত আছে। কাঠামোগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতিগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

এই সংগ্রহ শুধু প্রজননের জন্য নয়, বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও রেকর্ড সংরক্ষণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ—যার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে উষ্ণ সমুদ্র, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং দূষণের প্রভাব বোঝা যাবে।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়, তবে পৃথিবীর ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে—যা মানবজাতি ও প্রকৃতির জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

প্রবালপ্রাচীর কেবল সামুদ্রিক জীবের আবাসস্থলই নয়, বরং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত শত শত মিলিয়ন মানুষের খাদ্য, ঝড় থেকে সুরক্ষা ও জীবিকা নিশ্চিত করে।

উষ্ণ সমুদ্র ও ধ্বংস

সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়লে প্রবাল তাদের শরীরে থাকা শৈবাল ত্যাগ করে। এ শৈবাল তাদের শুধু রঙ নয়, খাদ্যও সরবরাহ করে। একবার সাদা হয়ে গেলে প্রবাল রোগাক্রান্ত ও অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়।

২০২৩ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে একটি প্রবাল-সাদা হওয়ার বা বিবর্ণ হওয়ার ঘটনা ঘটছে, যা প্রশান্ত, ভারত ও আটলান্টিক মহাসাগরের ৮৪ শতাংশ প্রবালপ্রাচীরকে আচ্ছন্ন করেছে।

আন্তর্জাতিক প্রবাল সংরক্ষণ অংশীদারিত্ব (আইসিআরআই) এ বছর জানিয়েছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে প্রবালপ্রাচীরের জীবন্ত আচ্ছাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।

আগামী সপ্তাহে ফ্রান্সে জাতিসংঘের একটি মহাসাগর বিষয়ক সম্মেলন বসবে। সেখানে দেশগুলোকে সমুদ্র সংরক্ষণের জন্য তহবিল ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চাপের মুখে পড়তে হবে।

তবে গভীর সমুদ্র খনন, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং অতিমাত্রায় মাছ ধরার মতো বিষয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে মতপার্থক্য থাকায় এই তৃতীয় ইউএন মহাসাগর সম্মেলনে ঐকমত্য এবং অর্থ সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

‘সময়ের জানালা বন্ধ হয়ে আসছে’

ও’ব্রায়েন বলেন, 'গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ এখনও আবার বাড়-বাড়ন্ত হওয়ার সামর্থ্য দেখিয়েছে, তবে বারবারের আঘাতের মধ্যে দিয়ে তা পুনরুদ্ধারের যথেষ্ট সময় পাচ্ছে না।'

তবে বিশ্বজুড়ে হাতে গোনা কয়েকটি ক্রায়োব্যাংকের মধ্যে এই তারোঙ্গা ব্যাঙ্ক কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে।

গত বছর তারোঙ্গা এবং অস্ট্রেলিয়ান মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা হিমায়িত প্রবাল-শুক্রাণু দিয়ে নতুন ডিম নিষিক্ত করে প্রবাল লার্ভা তৈরি করতে সক্ষম হন এবং সেগুলো রিফে প্রতিস্থাপন করা হয়।

এটি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের জন্য বিশ্বে প্রথম ঘটনা, এবং প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সেই প্রবাল ভালোভাবেই বেড়ে উঠছে।

এই উদ্যোগগুলো—প্রবালকে ছায়া দেওয়া থেকে শুরু করে তাপ সহনশীল প্রজাতি প্রতিস্থাপন পর্যন্ত নানা চেষ্টার অংশ—তবে এ সবই 'বৈশ্বিক প্রবাল সঙ্কটের ক্ষুদ্র অংশমাত্র,' বলেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) অস্ট্রেলিয়ার মহাসাগর বিষয়ক প্রধান রিচার্ড লেক।

তবে তিনি সতর্ক করেন, প্রবাল রক্ষায় আরও অনেক কিছু করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, 'প্রবাল অত্যন্ত সহনশীল এবং বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েও চমৎকারভাবে ফিরে আসতে পারে।'

'জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও প্রবাল টিকিয়ে রাখার এখনও সুযোগ আছে—তবে সেই সুযোগের জানালা দ্রুত বন্ধ হয়ে আসছে।'