বাসস
  ০৪ জুন ২০২৫, ১৩:০৬

প্রতিশ্রুত সামুদ্রিক অভয়ারণ্য গঠনে ব্যর্থতার পথে বিশ্ব

ঢাকা, ৪ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩০ শতাংশ সমুদ্রকে সুরক্ষিত অঞ্চলে পরিণত করার যে বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা বর্তমানে আগের চেয়ে আরও বেশি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে—এমনটাই বলছেন সংরক্ষণকর্মীরা। লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি যেমন কম, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে যাওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

ফ্রান্সের ব্রেস্ট থেকে এএফপি জানায়, সিয়াটলভিত্তিক মেরিন কনজারভেশন ইনস্টিটিউটের প্রধান ল্যান্স মরগান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ শতাংশের কম সমুদ্র অঞ্চলকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা (এমপিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, আর এর মধ্যে মাত্র ২.৭ শতাংশ এলাকাই সম্পূর্ণ বা উচ্চমাত্রায় সুরক্ষিত—এ অবস্থায় ৩০ শতাংশ লক্ষ্যে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে।’

সংস্থাটি একটি অনলাইন মানচিত্রে এই সংরক্ষিত অঞ্চলগুলো হালনাগাদ করে থাকে। ২০২২ সালে ১৯৬টি দেশ কুনমিং-মন্ট্রিয়াল বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য কাঠামোর আওতায় এই ৩০ শতাংশ লক্ষ্যপূরণের অঙ্গীকার করেছিল।

মরগান বলেন, লক্ষ্যপূরণ এখন হুমকির মুখে কারণ ‘আমরা দেখছি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ তাদের পূর্বেকার দ্বিপক্ষীয় সমর্থনে গৃহীত সুরক্ষা পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে।'

এই মন্তব্যের ইঙ্গিত ছিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এপ্রিল মাসের নির্বাহী আদেশের দিকে, যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বৃহৎ সংরক্ষিত এলাকায় শিল্পপর্যায়ের মাছধরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ঘোষিত সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকার সংখ্যা ১৬,৫১৬টি, যা সমুদ্রের মোট আয়তনের মাত্র ৮.৪ শতাংশ কভার করে।

তবে এসব সুরক্ষিত এলাকার মান একরকম নয়—কোথাও মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, আবার কোথাও কার্যত কোনো বিধিনিষেধই নেই।

ফ্রান্সের সিএনআরএস-এর সামুদ্রিক সমাজ-পরিবেশ গবেষক জোয়াকিম ক্লোদে বলেন, ‘শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত অঞ্চলই এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যাতে মাছ ও পরিবেশের প্রকৃত উপকার হয়।’

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড্যানিয়েল পাউলি বলেন, ‘এমপিএগুলো আদতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষার জন্য তৈরি হয়নি, বরং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, একটি কার্যকর এমপিএ থেকে আশপাশের অঞ্চলে মাছ 'রপ্তানি' হয়, যা মাছের প্রাপ্যতা বাড়ায়—এটাই হওয়া উচিত সংরক্ষিত অঞ্চল গঠনের মূল উদ্দেশ্য।

অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোনো অঞ্চল মাছ ধরার বাইরে রাখা হয়, তখন সেখানকার মাছের সংখ্যা বেড়ে যায়, এবং এই ‘স্পিলওভার’ প্রভাব আশপাশের এলাকাতেও মাছের সরবরাহ বাড়ায়।

হাওয়াই অঞ্চলের মাছ ধরার জন্য নিষিদ্ধ একটি বৃহৎ এলাকা নিয়ে ২০২২ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে ইয়েলোফিন টুনা মাছের পরিমাণ ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। এখন ট্রাম্পের আদেশে সেই অঞ্চল হুমকিতে।

গবেষক জোয়াকিম ক্লোদে  বলেন, এই ধরনের অভয়ারণ্য কার্যকর করতে হলে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ২.৭ শতাংশ সামুদ্রিক অঞ্চলেই এমন নিষেধাজ্ঞা আছে। আর এসব অঞ্চল সাধারণত মানুষের প্রভাব থেকে দূরবর্তী এলাকায় অবস্থিত।

উদাহরণ হিসেবে ইউরোপে, ওসেনা নামের একটি এনজিওর মুখপাত্র আলেক্সান্দ্রা কুস্টো বলেন, ‘৯০ শতাংশ ইউরোপীয় সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল এখনও বটম-ট্রলিংয়ের শিকার। এটা প্রকৃতিগত দিক থেকে সম্পূর্ণ বোকামি।’

অধ্যাপক পাউলি বলেন, ‘সংরক্ষিত অঞ্চলে বটম-ট্রলিং করা মানে ফুল তুলতে গিয়ে বুলডোজার চালানো।’

ওসেনা জানায়, ২০২৪ সালে ফ্রান্সের সংরক্ষিত অঞ্চলে ১৭,০০০ ঘণ্টা ও ব্রিটিশ জলসীমায় ২০,৬০০ ঘণ্টা ধরে বটম-ট্রলিং চালানো হয়েছে। তারা এই পদ্ধতিটি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এতে ভারী জাল সমুদ্রতলের ওপর টেনে নিয়ে পুরো এলাকা ধ্বংস করে ফেলা হয়।

সম্প্রতি ডব্লিউডব্লিউএফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাত্র ২ শতাংশ জলসীমাই এমন সংরক্ষিত এলাকা, যেখানে বাস্তবিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আছে—অনেকক্ষেত্রে সেখানেও কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত নেই।

ডব্লিউডব্লিউএফ ইউরোপীয় মহাসাগর কার্যালয়ের প্রধান জ্যাকব আর্মস্ট্রং বলেন, এসব ব্যবস্থা সমুদ্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় মোটেই যথেষ্ট নয়।

তিনি বলেন, সরকারগুলোকে কথার পাশাপাশি কাজও করতে হবে, নইলে এসব অঞ্চল শুধু মানচিত্রের ওপর প্রতীকী চিহ্ন হিসেবেই থেকে যাবে।