শিরোনাম
ঢাকা, ৩ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে সোমবার দ্বিতীয় দফায় সরাসরি বৈঠকে বসে কিয়েভ ও মস্কোর প্রতিনিধিদল। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ আগ্রাসনে শুরু হওয়া যুদ্ধ বন্ধে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিরাদানের মধ্যস্থতায়। তবে আলোচনায় কোনো অস্ত্রবিরতির ঘোষণা আসেনি। খবর এএফপি'র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তাগিদে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে, তবে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের অবস্থান একেবারেই বিপরীত।
- ভূমি দাবি রাশিয়ার -
আলোচনা শেষে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থাগুলো ‘শান্তি স্মারকলিপি’ নামে মস্কোর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব প্রকাশ করে। এতে দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চল রাশিয়ার অধিভুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের হাতে থাকা ওই অঞ্চলের আরও কিছু এলাকা ছেড়ে দিতে হবে বলেও প্রস্তাবে বলা হয়।
২০২২ সালে রাশিয়া দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। মস্কোর দাবি, শান্তিচুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে এসব অঞ্চলের বাকি অংশ থেকেও ইউক্রেনকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
২০১৪ সাল থেকে দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপও রাশিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইউক্রেন সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, দখলকৃত অঞ্চলগুলোর ওপর রাশিয়ার অধিকার তারা কোনোদিন স্বীকার করবে না।
তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিছু অঞ্চল কূটনৈতিকভাবে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে হতে পারে, অর্থাৎ শান্তিচুক্তির শর্তে কিছু জমি হয়তো রাশিয়ার দখলে থেকেই যেতে পারে।
- ন্যাটো ও রাজনৈতিক শর্ত -
রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেন কখনোই ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারবে না। এছাড়া তারা প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর দাবিও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
২০২২ সালের আগ্রাসনের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টেলিভিশন ভাষণে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে জেলেনস্কিকে সরিয়ে দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মস্কোর ‘শান্তি স্মারকলিপি’ অনুযায়ী, অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলে ইউক্রেনকে সেনা হ্রাস করতে হবে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করতে হবে, এবং দেশের ভেতরে কোনো বিদেশি সেনা বা সামরিক অবকাঠামো রাখা যাবে না।
পুরো যুদ্ধজুড়েই রাশিয়া ইউক্রেনকে ‘নব্য-নাৎসি’ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে এর ‘বেসামরিকীকরণ’ ও ‘বি-নাৎসিকরণ’-এর দাবি জানিয়ে এসেছে।
- ভাষা ও অভ্যন্তরীণ বিধিনিষেধ -
রাশিয়ার প্রস্তাবে রুশ ভাষার জন্য আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দাবি করা হয়েছে এবং ইউক্রেনে 'নাৎসি প্রচারণা' নিষিদ্ধ করার শর্ত রাখা হয়েছে।
এছাড়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনী সীমিতকরণ, নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণাসহ পারমাণবিক অস্ত্রহীনতার নিশ্চয়তা, এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
আরও দাবি করা হয়েছে, যুদ্ধজনিত ক্ষতির জন্য কোনো পক্ষই ক্ষতিপূরণ চাইবে না এবং ইউক্রেনে রুশ অর্থোডক্স চার্চের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।
- ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দাবি -
জেলেনস্কি বারবার রাশিয়ার আরেকটি আগ্রাসন ঠেকাতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দাবি করে আসছেন। তার প্রথম পছন্দ ন্যাটোর সদস্যপদ, যাতে ইউক্রেন ‘আর্টিকেল ফাইভ’-এর অধীনে পড়ে—এটি কোনো এক সদস্যের ওপর আক্রমণ হলে সবাই মিলে প্রতিরোধ করে।
কিন্তু ট্রাম্প সরাসরিই বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ গ্রহণযোগ্য নয়। রাশিয়াও এই দাবিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এর পরিবর্তে ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিকল্প কোনো প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশ্রুতি চাইছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে একটি ‘ইচ্ছুক জোট’ গঠনের আলোচনাও চলছে, যারা অস্ত্রবিরতির পর ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করতে পারে। তবে ইউক্রেন চায়, এই নিশ্চয়তায় যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় সমর্থন থাকুক।
রাশিয়া জানিয়েছে, ন্যাটো সদস্য কোনো দেশ ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করলে তা মেনে নেওয়া হবে না।
- অস্ত্রবিরতি নিয়ে অবস্থান -
জেলেনস্কি চাইছেন অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে সব যুদ্ধবিরতি কার্যকর হোক। তার মতে, যুদ্ধবিরতি ছাড়া অর্থবহ শান্তি আলোচনা সম্ভব নয়।
রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেন, 'প্রথমত, পূর্ণ ও নিঃশর্ত অস্ত্রবিরতি। দ্বিতীয়ত, বন্দিমুক্তি। তৃতীয়ত, অপহৃত শিশুদের ফেরত আনা।'
রাশিয়া তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে ক্রেমলিন জানিয়েছে, আলোচনায় কোনো ধরনের অস্ত্রবিরতির সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছে না। তবে সেটি হতে হবে ‘মূল কারণ’ সমাধানের অংশ হিসেবে এবং একটি ‘দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে’ পৌঁছাতে হবে।
পুতিনের মতে, এই সংঘাতের মূল কারণ শুধু কিয়েভ নয়, বরং পশ্চিমা দেশগুলো এবং ন্যাটোও—যারা সাবেক সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট দেশগুলোকে নিজেদের পরিধিতে এনেছে।
রাশিয়ার আরও দাবি, যদি অস্ত্রবিরতি হয়, তবে ইউক্রেন যেন সেনা মোতায়েন বন্ধ রাখে এবং পশ্চিমা অস্ত্র প্রবাহ পুরোপুরি থামাতে হবে।