শিরোনাম

ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যার কোনো বয়স নেই এবং যা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এমনকি মাতৃগর্ভেও হতে পারে এই রোগ। এজন্য বিশেষ করে সন্তান-সম্ভবা অবস্থায় নারীকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়।
দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে চলেছেন আফরোজা। তার আগের সন্তানের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। কিন্তু এবার প্রেগন্যান্সির মাত্র চার মাসের মাথায় তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। এ নিয়ে পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। প্রতি সপ্তাহে একবার ডাক্তারকে দেখালেও শেষ রক্ষা হয়নি। ডায়াবেটিসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ মাসের মাথায় বাচ্চা অপসুত হয়ে যায়।
আনিস-মাহফুজা দম্পতি কয়েকদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলেন আরও একটি সন্তান নেবেন। তাদের আগের সন্তানের বয়স তখন সাত বছর। সেই অনুযায়ী তারা ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শও করল। ডাক্তারও তাদেরকে সাহস দিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাহফুজা গর্ভবতী হলো। কিন্তু গর্ভবতী হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় মাহফুজার ডায়াবেটিস ধরা পড়ল। ডায়াবেটিস এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাকে প্রতিদিন নিয়ম করে দু’বেলা ইনসুলিন নিতে হয়। অত্যন্ত সাবধানে এবং প্রতিনিয়ত ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে একটি সুস্থ ছেলে সন্তানের জন্ম হলো।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ গর্ভবতী নারীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অস্বাভাবিক পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রতি ছয়জন গর্ভবতী মায়ের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) মা ও প্রসূতি বিভাগ, ফিটোমেটাল মেডিসিন বিভাগ ও এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ প্রেগন্যান্সি বিষয়ক একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে।
এতে বলা হয়, সন্তান জন্মের ৬ সপ্তাহ পর শতকরা ৫০ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক হয়নি। আমাদের দেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে মা ও অনাগত শিশু উভয়ই ঝুঁকির সম্মুখীন। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মা ও সন্তানকে এর কুফল থেকে মুক্ত রাখা যায়।
গাইনোকোলজিস্ট ডা. মনোয়ারা বেগম বলেন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগীকে একজন ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। প্রয়োজনে ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকায় মাকে স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস সারাজীবন ধরে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের ডায়াবেটিস ধরা পড়লে তার দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। এ ডায়াবেটিস অনাগত নবজাতকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
মা ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নাসরিন বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের খুব নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে হয়। প্রসূতি মায়েদের যদি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তাহলে আরও অনেক বেশি যত্নশীল হতে হয়। কারণ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে রোগী এবং অনাগত সন্তানের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সবাইকে আরও বেশি সচেতন থাকতে হবে।
সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর এলাকায় সমান হারে ডায়াবেটিস রোগী বেড়ে চলেছে। গত দুই বছরে ৫৬ শতাংশ রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়মিত চিকিৎসা না করায়, ইনসুলিন নেওয়ার পরও ৮০ শতাংশের বেশি রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৫৪ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ২০৪৫ সালে তা প্রায় ৭৮ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। ২০২১ সালে ডায়াবেটিসের কারণে বিশ্বে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ১০০ জনের মধ্যে ২৬ জন নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।
বিএমইউ এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহাজাদা সেলিম বলেন, সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে যে গবেষণা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, দেশে মোট জনসংখ্যার ১০.৮ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে।
ডায়াবেটিসের কারণে অন্যান্য রোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান হলো হৃদরোগ। হৃদরোগের ৮০ শতাংশ রোগী ডায়াবেটিসের কারণে মারা যান। ৪০-৪৫ শতাংশের কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। এছাড়া অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণও ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস রোগীর ২৯ শতাংশ রেটিনোপ্যাথিতে ভুগছেন। ডায়াবেটিসের কারণে প্রজনন ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে।
বারডেম একাডেমির সাবেক পরিচালক ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. ফারুখ পাঠান বলেন, ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ রোগ কখনো সম্পূর্ণ সারে না। সারাবিশ্বে এই রোগটি বিদ্যমান। এই উপ-মহাদেশে এর প্রকোপ কিছুটা বেশি। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনযোগ্য, কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল নয়। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন বা বংশে কারও ডায়াবেটিস থাকলে অন্যরা যদি পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করে, ওজন ও মেদ বেড়ে যায়, তবে তাদেরও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে পড়তে হয়।