বাসস
  ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:২২

সুস্থ শিশুর জন্মদানে মায়ের সুস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ 

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সাত মাসের গর্ভবতী লাভলী। লিকলিকে স্বাস্থ্য, ফ্যাকাশে মুখমন্ডল। চোখে হলদেটে ভাব। খুকখুক করে কাশছিলেন। ১৬ বছর বয়সেই মা হতে চলেছেন লাভলী। চাঁদপুর সদর হাসপাতালে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। চাঁদপুর সদর উপজেলার ব্রাহ্মণসাকুয়া গ্রামের জি এম এরশাদের স্ত্রী লাভলী। শ্বশুরবাড়ির লোকজন কবিরাজি ওষুধ, তাবিজ, পানিপড়া এইসব টুকটাক চিকিৎসা করায়। লাভলীর স্বামী জানান, বাজারে রেডিও শুনে ও টেলিভিশন দেখে তিনি জানতে পারেন একটি সুস্থ শিশুর জন্য সুস্থ মায়ের দরকার। তাই তিনি তার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।

রাজধানীর হাজিপাড়াস্থ প্যানাসিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শিশু চিকিৎসক ডা. জহুরুল হক সাগর বলেন, যেসব নারী গর্ভাবস্থায় ও শৈশবকালে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে তাদের সন্তানরাও সমপরিমাণ পুষ্টি পায়, আর প্রসবকাল থাকে জটিলতামুক্ত। ওইসব শিশু স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মায়। বেড়ে ওঠে সুস্থভাবে। 

তিনি জানান, আমাদের দেশের একজন নারীর স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে প্রতিদিন ২০০০-২২০০ ক্যালরি প্রয়োজন। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৩০০ ক্যালরি ও একজন স্তন্যদায়ী মায়ের প্রতিদিন ৭০০ ক্যালরি বাড়তি শক্তির প্রয়োজন। স্তন্যদায়ী মায়ের এই বাড়তি শক্তির ৫০০ ক্যালরি তার প্রতিদিনের খাদ্য থেকে সংগৃহীত হয়। বাকি ২০০ ক্যালরি গর্ভাবস্থায় দেহে জমানো চর্বি থেকে তিনি পান। স্তন্যদায়ী মাকে তাই গর্ভাবস্থা থেকেই তার শিশুর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়।

তিনি জানান, রক্তস্বল্পতা, আয়োডিনের অভাব, কিশোরী বয়সে মা হওয়া ইত্যাদি কারণে কম ওজনের শিশু, মৃত শিশু, বিকলাঙ্গ শিশু জন্মানোর ঝুঁকি থাকে। পুষ্টির অভাবে যেসব নারীর প্রসবের রাস্তা ছোট বা অপ্রশস্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর আশংকাও বেশি থাকে। গর্ভবতী হওয়ার আগে যে মেয়ের ওজন ৪০ কেজির নিচে থাকে সেই মেয়ে প্রসবকালীন সময়ে কম ওজনের শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে।

তিনি জানান, গর্ভাবস্থার শেষ দিকে গর্ভের সন্তানের বৃদ্ধি বেশি হয়। এ সময় গর্ভবতী বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলে গর্ভের সন্তানের পুষ্টি বৃদ্ধি ঘটে। 

অনুন্নত দেশগুলোতে ৬০ ভাগ গর্ভবতী মা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অনেক সময় সন্তান জন্ম নেয়। একজন মায়ের সাধারণ ও মাঝারি মাত্রার অপুষ্টিতে বুকের দুধের পরিমাণ ও গুণেরও তারতম্য ঘটে। শিশুর যখন ৫-৬ মাস বয়স তখন একজন স্বাভাবিক মা প্রতিদিন ৯০০-১০০০ সি.সি দুধ তৈরি করেন। ঠিক এই সময় একজন অপুষ্টিতে ভোগা মা দিনে ৫০০ সি.সি’র বেশি দুধ তৈরি করতে পারেন না। দুধের গুণগত মান অর্থাৎ দুধের আমিষ, শর্করা, চর্বি ও অন্যান্য ভিটামিনও কমে যায়।

শিশু বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদরা জানান, একজন গর্ভবতী নারীর পুষ্টি তার শৈশব ও কৈশোরকালীন পুষ্টির ওপরও বহুলাংশে নির্ভর করে। একজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী গর্ভবতী নারীই পারেন একটি সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়ে সন্তান পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, বঞ্চিত হয় সংসার জীবনে এসেও। আর এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নিজের ওপর, গর্ভস্থ সন্তানের ওপর। এ দেশে জন্ম নেয়া অস্বাভাবিক, বিকলাঙ্গ শিশুদের নিয়ে করা কেসস্টাডিতে এর সত্যতা মেলে। 

তারা আরো জানান, যে মা শিশুকে দুধ দেন তাকে স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে একটু বেশি খাবার খেতে হবে। 

যেমন- ভাত, মাছ, ঘন ডাল, সবুজ শাকসবজি, গোশত, দুধ, ডিম, হলুদ তাজা ফল ইত্যাদি। স্বাভাবিক খাবারের সাথে একমুঠো ভাত ২৪০ ক্যালরি, এক-দুই মুঠো ডাল ১২০ ক্যালরি, এক চামচ তেল ৫০ ক্যালরি, একটি পাকা পেঁপে ৯০ ক্যালরি- এই খাবার তাকে খেতে হবে। তারা জানান, দারিদ্র্র, পুষ্টি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, গর্ভকালে অত্যধিক পরিশ্রম, অল্প বয়সে মা হওয়া, নিজের ও পরিবারের লোকজনদের অসচেতনতাই মূলত একজন গর্ভবতীর অপুষ্টির প্রধান কারণ। 

এসব কারণে গর্ভবতী লাভলী মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। আর লাভলীর অপুষ্টির কারণে তার সন্তানও অপুষ্টির শিকার হতে পারে। পুষ্টি সম্পর্কে লাভলীর ধারণা অস্পষ্ট। কিছু জানলেও অভাবী সংসারে সে জানাও থেকে যায় অজানা। 

স্বামী এরশাদ বলেন, ‘লাভলীর যখন পনের বছর বয়স, তখন তারে বিয়ে করি। আমার আয়-রোজগার কম, তাই আলগা ভালা কিছু খাওয়ানোর উপায় নাই। প্রায়ই তার মাথা ব্যথা ও জ্বর হয়। শরীর দুর্বল, সর্দি-কাশি সারে না। তাইতো লইয়া আইছি ডাকতরের কাছে।’

শুধুমাত্র গর্ভকালীন অপুষ্টির কারণে, এ সময়ের সেবা ও সুচিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর দেশে বহু নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ৫১ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তশূন্যতাজনিত সমস্যায় ভুগছেন, জন্ম দিচ্ছেন মৃত-বিকলাঙ্গ-কম ওজনের শিশু। পুষ্টিহীন, স্বাস্থ্যহীন ভবিষ্যতের পথে পা রাখছে লাভলীর মতো নারীরা।