বাসস
  ২৪ জুন ২০২৫, ১৬:৩৫

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধে অবিলম্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের

 বরুন কুমার দাশ 

ঢাকা, ২৪ জুন, ২০২৫ (বাসস): বর্ষাকালে পুরোদমে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার আগেই দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় অবিলম্বে সব ধরণের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেছেন, এই বছরের আবহাওয়ায় ডেঙ্গু বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ভয়ংকর গাণিতিক বিস্তারের বিপরীতে যতগুলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আছে, তার সবগুলোরই ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেন, চলতি বছরের আবহাওয়া পরিস্থিতি ডেঙ্গুর অনেকটাই অনুকূলে। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস এপ্রিল। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিলে থেমে-থেমে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে এবং বায়ুমণ্ডলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ আর্দ্রতা থাকলে তা এডিস মশা প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী আবহাওয়া।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর পিক সিজন হবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে।

এবার বছরের শুরু থেকেই আগ্রাসী রূপ দেখাতে শুরু করেছে। জানুয়ারি মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবছর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, এই বছর যে ঘন-ঘন বৃষ্টি, আবার গরম পড়ছে, এতে এডিস মশা বিস্তারের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবার বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের ২২ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৮ হাজার ১৫০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ৩২ জন। ফেব্রুয়ারি মার্চের দিকে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও পরবর্তী সময়ে ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। 

আক্রান্তদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে এক হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন এবং চলতি জুন মাসের ২৩ দিনে  ৩ হাজার ৮০৫ জন। 

এদিকে এ বছর (২৩ জুন পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন এবং চলতি মাসে (২৩ জনু পর্যন্ত) ১১ জন।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্ট রেয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এডিস মশার ঘনত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। মশার ঘনত্ব পরিমাপের একটি মাপকাঠি হচ্ছে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’। 

কোনো এলাকায় এই ইনডেক্স যদি ২০ বা তার বেশি হয়, সেটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বর্তমানে ঢাকার অনেক এলাকায়ই এই ইনডেক্স ২০-এর ওপরে এবং কিছু এলাকায় তা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ঢাকা নয়, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও চাঁদপুরে এডিস মশার ঘনত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আইইডিসিআরের জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরে রাজধানীর বহুতল ভবনের ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, যেখানে গত বছর মে মাসে এই হার ছিল ৪২ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। 

ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ঝিনাইদহ (৬০%), মাগুরা (৫৫ দশমিক ৫৬%), পিরোজপুর (২০%) ও পটুয়াখালী (১৯ দশমিক ২৬%)। ঝিনাইদহে ২৭০টি বাড়ি পরিদর্শনে ১৬২টি পাত্রে, মাগুরায় ১৫০টি, পিরোজপুরে ৫৪টি এবং পটুয়াখালীতে ৫২টি পজিটিভ কনটেইনার পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ডেঙ্গু একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি চ্যালেঞ্জ, শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এককভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

ডেঙ্গু মোকাবিলার দায়িত্বটা আসলে মাল্টিডিসিপ্লিনারি। এখানে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশনও আমাদের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) অংশীদার। আমরা মূলত কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার বিষয়টা দেখি। এর বাইরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে কাজ করে বাকি দু’টি প্রতিষ্ঠান।

আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বরগুনায় ডেঙ্গুর বিস্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. হালিমুর রশিদ বলেন, বরগুনায় অতিরিক্ত ডাক্তার ও স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। সেখানে জলাবদ্ধতার কারণে ডেঙ্গু বেড়েছে। আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রায় ১ হাজার ১০০ জন মশক নিধন কর্মী সকাল-বিকেল শিফটে কাজ করে যাচ্ছেন। এডিস মশা প্রতিরোধে এবার দ্বিগুন ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিএসসিসি এলাকায় ‘ফগার মেশিনে’ ৩০ লিটারের পরিবর্তে ৬০ লিটার কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে।