শিরোনাম
ঢাকা, ১৮ মে, ২০২৫ (বাসস) : বার বছর বয়সী সিনথিয়ার দূরন্তপনায় তার বাবা-মাসহ স্কুলের শিক্ষকরা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকেন। প্রায় প্রতিদিনই স্কুলের সহপাঠীদের কেউ না কেউ শিক্ষকদের কাছে নালিশ করে সিনথিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু পড়ালেখায় ভালো হওয়ায় শিক্ষকরা তাকে খুব বেশি বকাঝকাও করেন না। কাছে ডেকে বুঝিয়ে বলেন শুধু। অভিযোগ গুরুতর হলে ডাক পড়ে বাবা অথবা মায়ের। বাবা কখনো গায়ে হাত না তুললেও মা ঠিকই মারেন। তারপরও সিনথিয়া দমবার পাত্রী নয়।
কিন্তু হঠাৎ একদিন সিনথিয়া কান্না করে করে বাড়ি ফিরে আসে। মাও খুব অবাক। বারবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর নেই তার। পরে রাতে মা তাকে কাছে ডেকে অনেক আদর করে জানতে চাইল কি হয়েছিল স্কুলে। তখন সিনথিয়া তার স্কুল ড্রেসের পায়জামা দেখায় মাকে। সেখানে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ভয়ে মেয়ে আবার কান্না শুরু করে দেয়। মা অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করে।
সিনথিয়ার মত বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেয়ে পিরিয়ড নিয়ে ভয় এবং অনিশ্চয়তায় থাকে। ভয়ে তারা এ বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে না। এমনকি মাকেও তারা এ বিষয়ে কিছু জানায় না। বিরাট কোন অসুখ হয়েছে ভেবে তারা চুপ করে থাকে। আবার অনেক মেয়ে বিষয়টি নিয়ে মা, খালা, ফুফু অথবা বড় বোনের সাথে আলাপ করলেও তারাও সঠিক পথ দেখাতে পারেন না। তারা নিজেরা যেভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করেছেন, সেই পথই দেখিয়ে দেন মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটি সেই অন্ধকার তিমিরেই থাকে।
আবার অনেক মেয়ে এ সময় ভয়ে স্কুল যাওয়াও ছেড়ে দেয়। নিজের মত করে এ সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। এরফলে দেশের অনেক মেয়েই ভোগে জটিল আরো অনেক রোগে।
মেয়েদের এসব সমস্যার কথা মাথায় রেখেই স্যানিটারী ন্যাপকিন প্রস্তুতকারী একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছে ‘স্কুল প্রোগ্রাম’ নামের এক কর্মসূচী। কয়েক বছর আগে চালু হওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল মেয়েরা যেন পিরিয়ড নিয়ে সচেতন হয়। ভয় না পেয়ে কীভাবে এই পিরিয়ডকালীন সময়ে সঠিক পরিচর্যা করা যায় সে বিষয়ে মেয়েদের জানানো। এবং এই পিরিয়ড নিয়ে মেয়েরা যেন স্কুলের শিক্ষিকা এবং তার মা অথবা বোন অথবা অন্য কোন কাছের আত্মীয়ার সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে।
জানা যায়, লৌহজংয়ের একটি গার্লস স্কুলে প্রথম এই প্রোগ্রামের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে এই কর্মসূচী। প্রথমে শিক্ষিকা এবং ছাত্রীরা আলোচনা করেন খোলামেলাভাবে। কারণ পরিবারের পর এই স্কুল শিক্ষিকারাই ছাত্রীদের কাছের হন। দিনের একটি বড় অংশ ছাত্রীরা শিক্ষিকাদের সাথে সময় কাটান। এরফলে ছাত্রীরা সহজেই তাদের শিক্ষিকাদের কথা বুঝতে পারেন।
এরপর শুরু হয় মূল পর্ব। প্রাথমিক পরিচয় শেষে ছাত্রীদের একটি ভিডিও দেখানো হয়। ভিডিও দেখানো শেষে একজন গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ ছাত্রীদের সাথে কথা বলেন। ছাত্রীদের পিরিয়ডের সাথে পরিচিত করেন। এসময় কীভাবে নিজের পরিচর্যা করতে হবে, শারীরিক অবস্থা কেমন হতে পারে, কোন ধরনের কাপড় ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ উপজেলার মডার্ণ গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রাফিজা বলেন আজ থেকে তিন বছর আগে আমাদের স্কুলে এই কর্মসূচী হয়। তখন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেসময় আমাদের যে উপকার হয়েছে তা আমার আজীবন মনে থাকবে। আমাদের স্কুলের প্রায় সব মেয়েই এই বিষয়ে এখন সচেতন। আবার যেসব শিক্ষার্থী নতুন ভর্তি হয় তাদেরকে আমাদের স্কুলের শিক্ষিকারা ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করেন। তাদেরকে সব বুঝিয়ে বলেন। যদি কোন সমস্যা হয় সাথে সাথে তা আমরা আমাদের শিক্ষিকাদের জানাই।
ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা জোবেদা খাতুন বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে স্কুলের মেয়েরা যেন স্বাস্থ্য সচেতন হয়। বিশেষ করে পিরিয়ড বিষয়ে। কারণ এটি এমন একটি বিষয় যা মেয়েরা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না। এমনকি অনেক মেয়ে এখনো পর্যন্ত তার মায়েদের সাথেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে না।
আমরা আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে মায়েদের নিয়ে মাঝে মাঝে বসি এবং তাদেরকেও এ বিষয়ে মেয়েদের সহযোগিতা করতে বলি।
একই স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী রোদেলা বলেন, প্রথমবার যখন আমার পিরিয়ড হয় তখন আমি ভয়ে অনেক কান্নাকাটি করি। প্রায় দশ দিনের মত স্কুলেও যাইনি। বাবা-মা বারবার স্কুলে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেও তাদেরকেও আমি কিছু বলতে পারিনি। পরে স্কুলে আসার পর আমার ক্লাস টিচার বারবার করে আমার স্কুলে না আসার কারণ জানতে চান। পরে তিনি আমাকে ডেকে আলাদা করে আমারা সাথে আলোচনা করেন। এবং আমি তাকে আমার শারীরিক সমস্যার কথা জানাই। তিনিই আমাকে বলেন, এটি কোন রোগ নয়। এটি সব মেয়েদের হয়। এতে ভয় বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। পরে তিনি আমার মাকে ডেকে তাকেও বিষয়টি জানান। এখন আমি আর স্কুল কামাই করি না।
পিরিয়ড একটি স্বাভাবিক জৈবিক পক্রিয়া। এ নিয়ে আতংকের কিছু নেই। এ স্বাভাবিক সত্য সকলেরই মেনে নেয়া প্রয়োজন। পিরিয়ড নিয়ে যেন কিশোরীরা আতংকে না ভোগেন সে বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টানো জরুরি বলে মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।