শিরোনাম
ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে একাধিক রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি প্রবাসীদের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রেমিট্যান্স হিসেবে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স। এটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৩.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় ২৬.৮০ শতাংশ বেশি। এছাড়া এটি পূর্ববর্তী রেকর্ড ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
গত গত মার্চ মাসে দেশে ৩.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে প্রবাসী আয়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এটি গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পাওয়া ২.৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই মাসে প্রবাসীরা প্রায় ২.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত বছরের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের পর সরকার যেসব তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ও প্রচারাভিযান চালিয়েছে, তা প্রবাসীদের হুন্ডির মতো অবৈধ পন্থা পরিহার করে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বাসস’কে বলেন, প্রকৃত পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে বড় পরিসরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, যা সাম্প্রতিক তথ্যেই প্রতিফলিত হচ্ছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বাসস’কে বলেন, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্যালান্স অব পেমেন্টসে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং পাশাপাশি টাকা-ডলারের বিনিময় হারও স্থিতিশীল রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব বিবেচনায় বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করেছি, যদিও এটি অন্যদেরও (আইএমএফের) পরামর্শ ছিল। অনেকের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বিনিময় হার মোটেও অস্থির হয়নি। টাকার ওপর মানুষের আস্থা এখন বাড়ছে।
ড. মাহমুদ আরও বলেন, এখন হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ফলে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স আটকে রাখার প্রবণতা থেকে সরে এসেছেন। আর এ কারণেই বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগের প্রবাহ প্রত্যাশিত মাত্রায় না বাড়লেও প্রবাসী-প্রধান এলাকাগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনীতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও বলেন, এটি বিনিয়োগে স্থবিরতা অনেকাংশেই পুষিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে প্রত্যাশিতভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েনি। এখন অর্থনীতি ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হচ্ছে এবং এর অন্যতম প্রধান কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ। পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. মনজুর হোসেন বাসস’কে বলেন, রপ্তানি আয় ও বিনিময় হারের পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহও ভালো অবস্থানে রয়েছে। কারণ গত কয়েক মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে এবং একই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে, যা প্রমাণ করে দেশের বৈদেশিক খাত তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, এখন প্রবাসীরা হুন্ডির মতো অবৈধ পন্থা বাদ দিয়ে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রবাহের সুবাদে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যালেন্স অব পেমেন্টস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী, নিট রিজার্ভ বর্তমানে ২৪.৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ব্যাংকাররা জানান, হুন্ডি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি বিদ্যমান স্থিতিশীল বিনিময় হারও প্রবাসীদের বৈধ পথে টাকা পাঠাতে আকৃষ্ট করেছে। কারণ ব্যাংক ও খোলাবাজারের হারের মধ্যে ব্যবধান এখন খুবই কম।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখন প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১২২.৮৯ টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে খোলাবাজারে এটি ১২৫ টাকা।
প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর হুন্ডি ও হাওয়ালার মতো অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানো চক্রের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এসব অবৈধ মাধ্যমে প্রবাসীদের নির্ভরতা কমে গেছে। ফলে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারও স্থিতিশীল হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায় । সেপ্টেম্বর মাসে ৮০.২৮ শতাংশ বেড়ে হয় ২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে ২.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, নভেম্বরে ২.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ডিসেম্বরে ২.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, জানুয়ারিতে ২.১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মার্চে ৩.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এপ্রিলে ২.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মে মাসে ২.৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জুন মাসে ২.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আসে।