বাসস
  ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬:৪১
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৪

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কাতর কান্নায় বেঁচে আছেন মা

প্রতিবেদন: রোস্তম আলী মণ্ডল

দিনাজপুর, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ (বাসস):  আমার ১৪ বছরের নাবালক পুত্রকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার ছেলের অপরাধ সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ছেলেটি অকালে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে।

আমার স্নেহের পুত্রকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি। বর্তমান অন্তবর্তী-কালীন সরকারের কাছে সন্তান হত্যার বিচার দাবি করছি। 

সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার ইসলামপাড়া মহল্লায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ আশিকুর ইসলামের মা আরিশা আফরোজের সাথে তার বাবার বাসায় বসে যখন আলাপ হচ্ছিল তখন তিনি এসব কথা বলেন। 

তিনি আরও বলেন, আমি একজন অসহায় মা। এক বছর বয়সী শিশু পুত্র সন্তানকে কোলে নিয়ে স্বামীর সংসার ত্যাগ করি। দর্জির কাজ করে সন্তানকে বড়ো করছিলাম। 

তিনি বলেন, আমার সাথে আমার প্রথম স্বামীর ১৩ বছর আগে বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর নিজের চেষ্টায় ঢাকা শহরে এসেছি। রামপুরা-বনশ্রী এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে দর্জির কাজ করছি। এই দর্জির কাজের রোজগারে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা শহরে ওই নাবালক সন্তান আশিকুর ইসলামসহ জীবিকা নির্বাহ করছি। 

আরিশা আফরোজ বলেন, আশিকুরের বয়স পাঁচ হলে, তাকে আমি রামপুরা এলাকায় একটি কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেই। তাকে নিয়ে এই এলাকায় একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে, খুব কষ্ট করে বসবাস করে আসছিলাম। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাধ্য হয়ে গত বছর পাঁচেক আগে দ্বিতীয় বিয়ে করি। কিন্তু আশিক আমাদের সাথেই থাকতো। 

তিনি বলেন, ঘটনার দিন গত ১৮ জুলাই দুপুরে আশিকুর ইসলামসহ স্বামীকে নিয়ে আমার ভাড়া বাসার মহল্লার একটি বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাই। দাওয়াত খাওয়া শেষ হলে আমি আমার দর্জির দোকানে ফিরে আসি। এর মধ্যে আশিক বাসায় যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে চলে যায়। 

সেদিন সন্ধ্যায় আশিকুরের মায়ের কাছে খবর আসে যে সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আশিকুর ইসলাম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। আশিকুরের গুলিবিদ্ধের সংবাদটি পেয়ে তার মা হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি দোকান থেকে দৌড়ে বনশ্রী জি- ব্লকে যান। সেখানে আশিকুর গুলিবিদ্ধ হয়েছে। স্থানীয় কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন, আহতদের উদ্ধার করে তাদের সহযোগীরা বনশ্রী অ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে গেছে। 

তিনি বলেন, এরপর আমি সেখান থেকে অ্যাডভান্স হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে এক ঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর আশিকুরের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ দেখতে পাই।

পুত্রের লাশ দেখার পর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। খবর পয়ে আমার সাবেক স্বামী ফরিদুলও আসেন। তিনি রিক্সা চালান। পরে আমরা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ১৯ জুলাই আশিকুরের লাশ তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নরহরিপুর গ্রামে নিয়ে যাই। একইদিন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

এ বিষয়ে শহিদ আশিকুর ইসলামের বাবা ফরিদুল ইসলামের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার আশিকুর তার মায়ের সাথেই বেশি সময় থাকতো। মাঝে মধ্যে সে আমার কাছে বেড়াতে আসতো। আমার এই পুত্র পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমি ও আমার পরিবারের সকলেই মর্মাহত ও শোকাহত। এখন আমার দাবি আমার এই সন্তানকে যারা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের যেন বিচার হয়।

আশিকুরের একমাত্র খালা আয়শা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছোট বোন আরিশা আফরোজ একজন দুঃখিনী মেয়ে। তার ছেলে আশিকুর ইসলামকে নিয়েই সে বেঁচে ছিল। সে এখন কিভাবে বেঁচে থাকবে এটাই আমরা ভেবে পাচ্ছি না। 

ঢাকা বনশ্রীর এডভান্স হাসপাতালে গত ১৮ জুলাই রাতে দায়িত্বে থাকা জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ অভিষেক কর্ণের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আশিকুর ইসলামকে নিয়ে আসার পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সে হাসপাতালে আসার আগেই মারা গেছে। 

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ১০ জন শহিদ হয়েছে। এর মধ্যে একজন আশিকুর ইসলাম। আমরা প্রশাসন থেকে এই মৃত্যু তালিকা করেছি। পরিবার গুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। 

আশিকুরের মা গত ২৭ জুলাই খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করতে যান। কিন্তু থানার কর্মকর্তা মামলা গ্রহণ করেননি। পরে তিনি পুত্রকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগে গত ২৮ আগস্ট ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ও ১৫০ জন অজ্ঞতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। 

বিচারকের নির্দেশে মামলাটি ঢাকা মহানগর খিলগাঁও থানায় গত নয় সেপ্টেম্বর হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নং ১৬ তাং ৯/৯/২০২৪। 
কয়েকজন আসামীকে পুলিশ ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে বলে আশিকুরের মা জানান। 

শহিদ আশিকুরের মা অন্তর্বতীকালীন সরকারের নিকট তার পুত্র হত্যার ন্যায্য বিচার দাবি করেছেন।