শিরোনাম

হাফিজুর রহমান
বরগুনা, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে মোঘল আমলের স্থাপত্য নিদর্শন এক গম্বুজ বিশিষ্ট ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদ। চারিদিকে সবুজ বৃক্ষ পরিবেষ্টিত এ অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে যে কারো মন জুড়িয়ে যায়। দেশের ঐতিহাসিক দর্শনীয় মসজিদগুলোর মধ্যে বিবিচিনি শাহী মসজিদ একটি অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কালের বিবর্তনে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে এ ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবিচিনি মসজিদটি। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মোঘল আমলে স্থাপিত মসজিদের অতীত রূপের উজ্জ্বলতা।
বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি ইউনিয়নে অবস্থিত বিবিচিনি শাহী মসজিদকে ঘিড়ে রয়েছে অনেক অলৌকিক ঘটনা। স্থানীয় লোকজনের জল্পনা কল্পনার যেন শেষ নেই। অনেকেই মনে করেন, এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিল পরী’রা। তাই এই মসজিদকে পরীর মসজিদ বলে মনে করেন স্থানীয় জনসাধারণ।
ঐতিহাসিক শাহী মসজিদটি যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং যার নাম এই মসজিদের নামের সাথে একই সুতোয় গাঁথা তিনি হলেন, আধ্যাত্মিক সাধক হজরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ।
জানা যায়, ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সুদূর পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রথমে তিনি দিল্লি আসেন। ওই সময় মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বঙ্গ দেশের সুবেদার এই মহান সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
তখন হজরত শাহ নেয়ামত উল্লাহ কয়েকজন শিষ্যকে সাথে নিয়ে এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা বরগুনার বিবিচিনি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে তার শিষ্য শাহ সুজার অনুরোধে এই গ্রামেই তিনি এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ শাহী মসজিদটি নির্মাণ করেন।
বরগুনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, হজরত শাহ নেয়ামত উল্লাহর কন্যা চিনিবিবির নামের সাথে মিল রেখে এই গ্রামের নামকরণ করা হয় বিবিচিনি। সমতল ভূমি থেকে এই মসজিদের অবস্থান প্রায় ৩৯ ফুট উচ্চ টিলার উপরে। এর দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট এবং প্রস্থ ৩৩ ফুট। চারপাশের দেয়াল ৬ ফুট চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ইটের রং ধূসর বর্ণের, ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং পুরো ২ ইঞ্চি, বর্তমান যুগের ইটের চেয়ে এর আকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা।
তৎকালীন সময় সাধক শাহ নেয়ামত উল্লাহর অনেক কীর্তি দেখে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ তার কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। কথিত আছে, ‘তখনকার সময় বিষখালী নদীর পানি প্রচুর লবণাক্ত থাকায় পানযোগ্য ছিল না। তাই তিনি মানুষের কষ্টের কথা ভেবে তার আধ্যাত্মিক সাধনার আশ্চর্য তসবিহ খানি বিষখালী নদীর পানিতে ধুয়ে দিলে সেই লবণাক্ত পানি মিঠা পানিতে পরিণত হয় এবং পানের উপযোগী হয়ে যায়।’
আরো জানা যায়, ‘ওই সময়ে বিষখালী নদী সুগন্ধা নদীর অংশ বিশেষ ছিল এবং এর পানি অতি মাত্রায় লবণাক্ত থাকায় মানুষ মুখে পর্যন্ত নিতে পারতেন না।’ একদিন চিনিবিবি নদীতে নেমে লবণ পানি মুখে নিয়ে তিনঢোক পানি পান করে বলেন, পানির বিষ খেয়ে ফেললাম, সেই থেকে এই নদীর নামকরণ করা হয় বিষখাই, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় বিষখালী নদী নামে। আরো কথিত আছে যে, ‘ওই সময় বিষখালী নদীতে ছিল কুমিরের অবাধ বিচরণ। কিন্তু তার অলৌকিক ক্ষমতার প্রভাবে পরবর্তীতে বিবিচিনি সংলগ্ন বিষখালী নদী এলাকায় কোন কুমির আসত না। এই নিয়ম আজও প্রচলিত আছে এমন ধারণা এলাকার মানুষের।
প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মসজিদটি দেখতে আসেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। তাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, এখানে মানত করলে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। দর্শনার্থীরা এখানে এসে নামাজ আদায় করেন।
মসজিদ পরিচালনার জন্য একটি কার্যকরী কমিটি রয়েছে। আর এই কমিটির সভাপতি হলেন, বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হরেকৃষ্ণ অধিকারী।
জানা গেছে, শুধু দেশেই নয় মোঘল স্থাপত্যের গৌরব ও মর্যাদার সাক্ষী হিসেবে ইতিহাসে ব্রিটিশ জাদুঘরে এই বিবিচিনি শাহী মসজিদের নাম উল্লেখ আছে, যা পাঁচশত বছর পূর্বের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবিচিনি শাহী মসজিদ এর ইমাম আবদুল মান্নান বলেন, আমি ২০ বছর ধরে এই মসজিদের দায়িত্বে আছি, বহু বছর ধরে কোন সংস্কার করা হয়নি। বর্তমানে মসজিদের কিছু সংস্কার কাজ করা দরকার। মসজিদের সামনের মাঠটি পাঁকা করে নামাজের জন্য উপযোগী করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি মসজিদের সংস্কারসহ মাঠটি পাঁকা করণের দাবি জানাই।
মসজিদের মোয়াজ্জেম মো. আবু হানিফ বলেন, আমি এই মসজিদে ২৭ বছর ধরে আছি, এটি পাঁচশত বছরের পুরোনো মসজিদ। এই ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদে জুমার নামাজ পড়া শুরু হয়েছে ১১০ বছর আগে।
স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ সর্দার (৬০) বলেন, এই মসজিদের কোন পরিচর্যা হচ্ছে না। মসজিদের ভিতরে ও বাইরে সংস্কারের দাবি জানাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি।
খুলনা থেকে আসা দর্শনার্থী রেজাউল ইসলাম বলেন, এক কথায় বলা যায়, এমন সৌন্দর্য শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়, এ অনুভবের যেন শেষ নেই। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের এখানে থাকার জন্য পর্যাপ্ত ডাকবাংলো প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক বিবিচিনি মসজিদটি সংস্কার করে মোঘল আমলের নিদর্শন ধরে রাখতে সরকারের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী।