শিরোনাম
প্রতিবেদন: শুয়াইবুল ইসলাম
সিলেট, ১ জুন, ২০২৫ (বাসস): সিলেটে টিলা কেটে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ঘরবাড়ি নির্মাণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি বেসরকারি পরিসংখ্যানে জানা গেছে, জেলায় পাহাড়-টিলায় বা টিলার নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। ফলে প্রতিবছর টিলা ধসে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে।
আজ রোববার জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষণাবন্দ এলাকায় টিলাধসে ঘুমন্ত একটি পরিবারের চার জনের প্রাণহানি ঘটে।
গত বছরের ১০ জুন সিলেট নগরের মেজরটিলা চামেলিবাগ এলাকায় টিলা ধসে শিশুসহ একই পরিবারের তিন জনের প্রাণহানি ঘটে।
২০২২ সালের ৬ জুন সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের পূর্ব সাতজনি গ্রামে টিলা ধসে একই পরিবারের চার জনের প্রাণহানি ঘটে। এভাবে প্রতিবছর টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
প্রশাসন বলছে, এই বছর মে মাসের মাঝামাঝিতে পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারী মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নিদের্শ দেওয়া হয়েছে। এলাকাগুলোতে মাইকিং করে তাদের বলা হলে অনেকে সরে যান। কিন্তু কেউ কেউ প্রশাসনের এই নির্দেশকে উপেক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করছিলেন। আজকের ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মাইকিংয়ের পাশাপাশি নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সিলেটে টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করা মানুষের পরিসংখ্যান নিয়ে একটি জরিপ চালায়। জরিপে দেখা গেছে, সিলেট শহরতলী ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে পাদদেশে ১০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এরপর আর কোনো জরিপ চালানো হয়নি। বর্তমানে এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই বলেন, ‘আমরা যখন জরিপ চালিয়েছি তার পরবর্তীতে অনেক টিলা কেটে ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে। এই সংখ্যা আরও দুই থেকে তিন হাজার বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, জরিপের সময় আমরা দেখেছি প্রভাবশালী মহল টিলার একাংশ কেটে সঙ্গে সঙ্গে টিনের আধা পাকা কিংবা পাকা দালান তুলে। বর্ষা মৌসুমে যখন একাধারে বৃষ্টি হয় তখন এগুলো ধসে ঘরবাড়িতে আছড়ে পড়ে এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটে প্রায় প্রতি বছর বর্ষাকালে টিলা ও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাস করা পরিবারগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই সিলেট জেলা প্রশাসনের কাছে।
প্রতি বছর টিলাধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায়িত্ব পালনের অনেকটা ইতি টানে প্রশাসন। অথচ গত ২০১২ সালে টিলার পাদদেশের বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার উচ্চ আদালতের আদেশ গত এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আখতার জানান, গত ১৩ বছর আগের উচ্চ আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ তারপরও থামেনি টিলা কাটা, টিলার পাদদেশের বাসিন্দারা মাটি চাপা পড়ে প্রাণহানির ঘটনা।
‘টিলা কাটা রোধে উচ্চ আদালতের রায়, আদেশ সম্বলিত সাইনবোর্ড লাগানো প্রসঙ্গ’ শিরোনামে জেলা প্রশাসককে দেওয়া বেলার ওই চিঠিতে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর এবং গোপালগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যমান পাহাড়, টিলা কর্তন রোধে ২০১১ সালে একটি জনস্বার্থমূলক মামলার প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১ মার্চ আদালতের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, পাহাড়, টিলা কর্তন থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে আদালত। একইসঙ্গে পাহাড়, টিলা কর্তনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি প্রদান, পাহাড়ে বিদ্যমান দখলদার উচ্ছেদ এবং পুনরায় অবশিষ্ট পাহাড়, টিলা কর্তন রোধ ও পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
সেই সঙ্গে আইন অনুযায়ী উল্লিখিত এলাকার স্থানীয় জনসাধারণের স্বার্থ, জীবনের ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশও ছিল আদালতের। এমন নির্দেশনার পরও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সিলেট সদর উপজেলার টুকের বাজার ইউনিয়নের জাহাঙ্গীর, খাদিম, বালুচর, জৈন্তাপুর উপজেলার গোয়াবাড়ী, শ্রীপুর, হরিপুর, ঠাকুরের মাটি এলাকায় টিলা কাটা চলছে বলে দাবি করে বেলা।
এই ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে আমরা আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। বর্ষার মে মাসের মাঝামাঝি থেকে মাইকিং, দফায় দফায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। শিগগিরই আরো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট সদর উপজেলার আখালিয়া, ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, টিলারগাঁও, মেজরটিরা, খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, বালুচর, পাঠানটুলা গুয়াবাড়ি জাহাঙ্গীরনগর, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলাসহ পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে সহস্রাধিক পরিবার। বাসিন্দারা কেউ ঘর ভাড়া নিয়েছেন, কেউ নামমাত্র টাকা দিয়ে দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা কিনেছেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলাসহ সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু পাহাড়-টিলা। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় দশকে সিলেটের ৬১টি টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জেলার ৪১২টি পাহাড়-টিলার মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৩৫১টি। সরকারি হিসাবে ধ্বংস হওয়া টিলার সংখ্যা ৬১টি বলা হলেও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছে-এমন বেসরকারি সংস্থাগুলোর দাবি, গত দেড় দশকে শতাধিক টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে এক হাজার ৭৪৫টি টিলা রয়েছে। টিলাভূমির পরিমাণ ২ হাজার ৭৪৯ দশমিক ৫০ একর। এর মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বেশির ভাগ টিলা। সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় ১০৫টি টিলা রয়েছে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ৬১৫টি টিলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৯১টি টিলা খাস খতিয়ানভুক্ত।
সিলেট সিটি করপোরেশন, সদর উপজেলা, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে ১ হাজার ২৫টি টিলা রয়েছে এবং ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এবং সদর ইউনিয়নে ২৫১ একর টিলাভূমি রয়েছে।